ব্যাংক যে হারে সুদ দিচ্ছে, তার তুলনায় মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। এতে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন ব্যাংকে অর্থ রাখা মানেই লোকসান। এমনিতেই ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কম। এ অবস্থায় আমানত রেখে ঠকলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা আরও কমে যাবে।
বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সংকটের সময় সাধারণত মানুষ ব্যাংকে অর্থ রাখে না, বরং জমি বা বাড়ির মতো অনুৎপাদনশীল খাতে তারা ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ে।
যেভাবে সাধারণ মানুষ ঠকছে
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় সুদের হার কম হলে তখন প্রকৃত সুদের হার ঋণাত্মক হয়। এখন যেমন হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১০। আর সে সময়ে দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের গড় ভারিত (ওয়েটেড এভারেজ) সুদহার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
ফলে একজন আমানতকারীর প্রকৃত সুদহার ছিল ঋণাত্মক ৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ (৯.১০-৪.০৯=৫.০১)। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যাংকে ১০০ টাকা রাখলে এক বছর পর আমানতকারী প্রকৃতপক্ষে পাচ্ছেন ৯৪ টাকা ৯৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রকৃত সুদের হার কমে গিয়ে বছর শেষে তার মূল আমানতও ৫ টাকা ১ পয়সা খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। এখানেই শেষ নয়।
একজন আমানতকারীর সুদ আয়ের ওপর দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর। ফলে প্রকৃত আয় আসলে আরও কমে যায়। নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। ফলে পরিস্থিতি প্রায় একই রকম আছে।
সুদহার জোর করে নয়-ছয় করে রাখার কারণেই সাধারণ মানুষের এই বিপত্তি। ২০২০ সালের শুরুতে সরকার ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেই হার এখনো বহাল আছে। অথচ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় সংকট চলছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে দেশগুলো সুদহার বাড়িয়েছে। ব্যতিক্রম তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ। আর সুদহারে কোনো পরিবর্তনই আনেনি বাংলাদেশ।
মূলত কিছু ব্যবসায়ীকে খুশি করতেই ঋণের সুদহার কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ঋণ নেওয়া সস্তা হয়ে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির মধ্যেও মুদ্রা সরবরাহ বাড়ছে। সেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে বেনামে ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে, এর বড় অংশ খেলাপি হচ্ছে, আরেক অংশ হচ্ছে পাচার।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
এ অবস্থায় সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুদহার কিছুটা বাড়ানোর এখনই সময়। কিন্তু সরকার অনড়। সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করে, সুদহার বাড়ালে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য সরকারের মধ্যেও ভিন্নমত আছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম শামসুল আলম সুদহার বাড়ানোর পক্ষে কথা বলেছেন। তবে সূত্রগুলো বলছে, ব্যবসায়ীদের তুষ্ট করতেই সুদহার কমানো হয়েছিল। সুতরাং নির্বাচনের আগের বছরে সরকার সেই পথ থেকে সরে আসতে চাইছে না।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সুদহার যে আজীবনের জন্য একই রকম রাখতে হবে, তা ঠিক নয়। বরং যখন মূল্যস্ফীতি কম ছিল, তখন সুদহার কমানো হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এখন যেহেতু আমদানি করা ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি দুটিই বেশি, এ রকম অবস্থায় আমানতকারীদের প্রকৃত আয় ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ফলে সঞ্চয় করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সুতরাং বিষয়টি অবশ্যই পর্যালোচনা করা দরকার।
মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে আরও বলেন, আমানতের সুদহার বাড়াতে হলে ঋণের সুদহারও বাড়াতে হবে। সুতরাং আমানতের সুদহার ৯ শতাংশ করতে হলে ঋণের সুদ ১২ বা ১৩ শতাংশে আনতে হবে। এর একটা প্রভাব তো বিনিয়োগের ওপর পড়বেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তা ছাড়া সুদহার বিনিয়োগের অনেকগুলো পূর্বশর্তের একটি। আরও অনেক বিষয়ের ওপরই নির্ভর করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার অন্যান্য ব্যয় কমাতে হবে, বাধাগুলো দূর করতে হবে। সেটা না করে কেবল সুদের হার এখনকার মতো রেখে দিলে আরও অনেক সমস্যার উদ্ভব হবে। যেমন বিনিময় হার এক জায়গায় রেখে দেওয়ার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়েছে। সুতরাং সুদহারকে এখন বাজার ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার।
এসডব্লিউএসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ