২০১৭ সাল থেকে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্বের সাথে সাথে জঙ্গি তৎপরতা, মাদক চোরাচালানের ঘটনা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সমর্থন হ্রাসের কারণে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে অবিশ্বাস বেড়েছে, যা গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও প্রাণহানির সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট দ্বারা সংগৃহীত আংশিক তথ্য অনুসারে, আন্তঃগোষ্ঠী সংঘর্ষে বা নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা আশেপাশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আরও ১৫ জন জঙ্গি ছাড়াও ৪৫ জন রোহিঙ্গা অপরাধী নিহত হয়েছে। ১৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এবং তার আশেপাশে আরও ১৫ জঙ্গি এবং ২৫ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি প্রায়শই বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যখন ২০১৭ সালের অগাস্ট থেকে ৭ লক্ষ ২৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল।
১৫ আগস্ট ২০১৭-এ, বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে অভিহিত করে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরে ৩০ টি মিয়ানমার পুলিশ পোস্ট এবং একটি সেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে, যাতে প্রায় ৮০ জন বিদ্রোহী এবং ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয় ।মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং এআরএসএ-র মধ্যে লড়াই তীব্র হওয়ায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২ এবং ২০১৬ সালে সহিংস হামলার পর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে সংগঠিত গ্যাংদের ক্রমবর্ধমান ও সক্রিয় উপস্থিতির কারণে বেআইনি কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। ১১ অগাস্ট ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুসারে, রোহিঙ্গারা অন্তত ২০ টি সংগঠিত সশস্ত্র দল গঠন করেছিল যারা বর্তমানে শরণার্থী শিবিরে সক্রিয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘সালমান শাহ গ্রুপ’, ‘পুটিয়া গ্রুপ’, ‘মুন্না গ্রুপ’, ‘হাকিম গ্রুপ’ রয়েছে এবং ‘জোকির গ্রুপ’। এই চক্রগুলো অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিল। তারা ডাকাতি, চুরি, সাইবার অপরাধ, যৌন হয়রানির পাশাপাশি অবৈধ সিম কার্ড এবং হুন্ডি (মানি লন্ডারিং) ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জমি দখলের সাথে জড়িত ছিল। এই সংগঠিত রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলগুলো কিশোরদেরও কাজে লাগায়। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত করে যে, শিবিরগুলিতে অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বাড়ছে।
২২ আগস্ট ২০২২- এ একটি প্রতিবেদনে কক্সবাজার পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল ইসলা প্রকাশ করেছেন যে, ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে ২০ আগস্ট ২০২২ এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট ২,৪৩৮টি অপরাধ নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০০টি হত্যা মামলা রয়েছে যার বেশিরভাগই ছুরি বা বন্দুক দিয়ে করা হয়েছে। ১৮৫টি অস্ত্র রাখার মামলা, ১৬৩৬টি মাদক মামলা, ৩৯টি অপহরণ এবং ১৩ টি নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে ।এই অপরাধের জন্য মোট ৫,২২৬ জন শরণার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১ অক্টোবর ২০২১-এর প্রতিবেদন অনুসারে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে জড়িত অপরাধমূলক মামলাগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭ সালে ৭৫ টি, ২০১৮ সালে ২০৮, ২০১৯ সালে ২৬৩ , ২০২০ সালে ১৮৪ এবং ২০২১ সালের প্রথম আট মাসে ৫৭০ টি মামলা ঘটেছে।
এই দলগুলো মাদক পাচারের বিকল্প পথ তৈরি করেছে। বিশেষ করে মেথামফিটামিন এবং ইয়াবা ট্যাবলেট (মেথামফিটামিন এবং ক্যাফেইনের ককটেল), বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, কারণ পুরানো টেকনাফ পথটি কঠিন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ও সতর্কতাবৃদ্ধির কারণে। উল্লেখযোগ্যভাবে ২০২১ এর ৯ জুন বাংলাদেশে ২০১৮ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ডের প্রথম ঘটনা সামনে আসে। কক্সবাজারের উখিয়া সেক্টরের কুটাপালং ক্যাম্প ২-এর ২৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা বাসিন্দা মোহাম্মদ আরিফকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। মেথামফিটামিন ট্যাবলেট দখল ও চোরাচালানের দায়ে নিম্ন আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় হয়।
যদিও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি সাধারণত মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে পড়ে না, তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন একটি ব্যতিক্রমি রায় দিয়েছিলেন। তিনি আরিফের কর্মকাণ্ডকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার উপর আক্রমণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। রায়ে আল মামুন বলেন, “আসামি একজন পূর্ণ বয়স্ক, সুস্থ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। ইসলামের বিধান সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েও রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারি (ইয়াবা ব্যবসা) মাদক চোরাচালান করে দেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।”
এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছাড়াও এআরএসএ, মায়ানমারভিত্তিক একটি উগ্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করছে। এআরএসএ ক্যাম্পের অভ্যন্তরে কমপক্ষে ১৫০ ক্যাডারের একটি দল তৈরি করেছে, তারা রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের লক্ষ্যবস্তু করেছিল। এই যুবকরা বাংলাদেশ পুলিশের এপিবিএন এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সাথে অপরাধী চক্রের গতিবিধি এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য ভাগ করে নিচ্ছিল। ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১-এ, রোহিঙ্গা নেতা ও কর্মী মহিব উল্লাহকে কুতুপালং ক্যাম্পে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, আদর্শগত পার্থক্য এবং ARSA এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে। এর পরেই ক্যাম্প ১৮-এর দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসায় অপরাধীরা রক্তপাত শুরু করে। এআরএসএ’র বিরোধিতা করায় মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা আকিজ সহ ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়।
পরবর্তীতে ৫ মার্চ ২০২২ এপিবিএন উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে এআরএসএর উলামা শাখার ‘প্রধান কমান্ডার’ জাকারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সুপার (এসপি) নাইমুল হকের মতে, জাকারিয়া মহিব উল্লাহকে হত্যার ‘ফতোয়া’ জারি করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা চলছে বলে উল্লেখ করে ২৯শে আগস্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন যে অপরাধ এবং চোরাচালান রোধে প্রয়োজনে শরণার্থী শিবিরে সেনা মোতায়েন করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করা হবে যাতে তারা কোনো অবৈধ কার্যকলাপ করতে না পারে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়ে মন্ত্রী উল্লেখ করেন, “আমি আশা করি শিগগিরই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে। সরকারের প্রচেষ্টা এখনো চলছে।”
ইতিমধ্যে ১৭ অক্টোবর, বাংলাদেশের মধ্যে পুনর্বাসনের ১৪তম ধাপে ৯৬৩ জন রোহিঙ্গার একটি নতুন দল ভাসানচর (নোয়াখালী জেলার একটি দ্বীপ) পৌঁছেছে। এ নিয়ে ভাসান চরে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩০,০৭৯ এ পৌঁছেছে বলে ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট হাসেম জানিয়েছেন।২০২০ সালে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।অনেক রোহিঙ্গা ভাসান চরে বসতি স্থাপন করতে ইচ্ছুক নয়, এবং রিপোর্টগুলি ইঙ্গিত করে যে কিছু রোহিঙ্গা এবং চরমপন্থী দল তাদের মাদক পাচার ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভাসান চরে প্রত্যাবাসন বা পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মধ্যে সহিংসতার নতুন খবরের সাথে, উদ্বাস্তুদের উপচে পড়ার পাশাপাশি অপরাধ ও সহিংসতার বিভিন্ন নিদর্শন সামনে আসছে । এই পরিস্থিতিতে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ