পুলিশ হেফাজতে ইরানের কিশোরী মাহশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় চলমান বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ৩২৬ জন নিহত হয়েছেন। নরওয়ে ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) শনিবার (১২ নভেম্বর) এ তথ্য জানায়। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
কী উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে?
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকমত হিজাব না পরার অভিযোগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাহশা আমিনিকে তেহরান থেকে আটক করে ইরানের নীতি পুলিশ। আটকের পর পুলিশ হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এরপর তাকে তেহরানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নির্যাতনে মাহশার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে ইরানের মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। এই বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি নিজেদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে জানায়, দেশজুড়ে চলা বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৪৩টি শিশু ও ২৫ জন নারীসহ অন্তত ৩২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
৫ নভেম্বর সংগঠনটি যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখান থেকে আজকের তালিকায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ২২ জন বেড়েছে। নতুন তালিকায় জানানো হয়, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশেরই ১২৩ জন রয়েছেন। এক সপ্তাহে সেখানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ৫ জন।
এই বিক্ষোভের মধ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী জাহেদানে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে। সেদিন জুমার নামাজের পর নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভ দমনে গুলি চালায়। এক পুলিশ কমান্ডারের বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল, প্রদেশটির বন্দরনগরী চাবাহারে পুলিশ হেফাজতে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
এদিকে আইএইচআর এর পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোঘাদ্দাম এই দমন পীড়ন বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এক বিবৃতিতে জানান, জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত ও জবাবদিহি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ দুই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অপরাধীদের জবাবদিহি করার প্রক্রিয়াকে সহজ করবে ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে চলমান দমন পীড়নের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশও মাহসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টাইমস স্কয়ারের সামনে জড়ো হন শত শত আন্দোলনকারী। এ সময় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ বন্ধের আহ্বান জানান তারা। বিক্ষোভ হয়েছে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভেও। এ সময় ইরানের প্রশাসনের নিন্দা জানান অংশগ্রহণকারীরা।
এদিকে, ইরানে বিক্ষোভকারী নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি জাতিসংঘের প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি নিহতের ঘটনা আরও বাড়তে পারে, এমন শঙ্কা জানিয়ে তেহরানের বিষয়ে অবিলম্বে বিশেষ একটি অধিবেশনের আহ্বানও জানায় সংস্থাটি।
বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ইরান আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে বলেও দাবি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে তেহরান। আমরা খবর পেয়েছি অনেক বিক্ষোভকারীর পরিবারকে হয়রানি করছে ইরানের পুলিশ। এমনকি বিক্ষোভে নিহত অনেকের মরদেহ ফেরত দেয়া হচ্ছে না। শিগগিরই আমাদের পক্ষ থেকে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জাতিসংঘের রিপোর্ট
আধুনিক যুগেও ইরানে নারী ও কন্যাশিশুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
জাতিসংঘে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ দূত ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ জাভেদ রেহমান এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেন। এতে বলা হয়, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার ইরানের নারীরা। উদ্বেগ জানানো হয় নারীদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা নিয়েও।
রেহমান বলেন, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নারীবিদ্বেষী আচরণে জর্জরিত ইরানের নারীদের নিত্যদিনের জীবন। বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দিনদিন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে দেশটিতে।
বাল্যবিবাহের ওপর আলোকপাত করে বলা হয়, গত বছরের ছয় মাসে দেশটিতে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সী ১৬ হাজার কন্যা শিশুর বিয়ে হয়েছে।
রেহমান বলেন, ‘নারী ও মেয়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে বাল্যবিবাহের প্রশ্ন। ইরানে বিয়ের ন্যূনতম বয়স নিয়ে যে আইন রয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ইরানে বাবার অনুমতি সাপেক্ষে কন্যাসন্তানের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর। বিচারকের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আরো কমবয়সেও মেয়েদের বিয়ে হওয়ার নিয়ম আছে দেশটিতে।
রেহমান জানান, বিয়ে, বিচ্ছেদ, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রকটভাব দৃশ্যমান ইরানে। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় নারীদের।
প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে বিরোধিতাকারীদের ওপর তেহরানের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা।
বলা হয়, ইরান সরকারের আক্রমণ থেকে বাদ পড়ছে না নারী, শিশু, মানবাধিকার কর্মী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী, লেখক, সাংবাদিক ও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে- এমন ব্যক্তিরা। নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানি, বিচারবহির্ভূত আটক, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা, মৃত্যুদণ্ডসহ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার এই বিপুলসংখ্যক মানুষ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ