বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কিছু শর্তের ‘বৈষম্যমূলক প্রভাব’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গতকাল শনিবার (৫ নভেম্বর) টিআইবির পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ঋণ আলোচনায় আইএমএফ নিজস্ব নীতি বিশেষ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর কৌশলগত বিষয়ে মনোযোগ দিতে হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো না নিয়ে তৈরি করা শর্তের প্যাকেজ কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জন করবে এমন সম্ভাবনা কম। বরং এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত চাপে থাকা দেশের সাধারণ মানুষের ওপর বৈষম্যমূলক প্রভাবের বাড়তি বোঝা তৈরি হবে।
টিআইবি মনে করে, ‘জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি সংস্কারের মতো কিছু শর্তের সম্ভাব্য অসম প্রভাবের বিষয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত। শর্তের পুরো প্যাকেজকে এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত চাপে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর বৈষম্যমূলক প্রভাব আরও বেড়ে না যায়।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, আইএমএফের ঋণ দেওয়া ব্যবসার অপরিহার্য বাস্তবতা হলো তাদের দেওয়া শর্তগুলো প্রায়শই কঠিন এবং অপ্রীতিকর হয়। তবে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশের নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে উদ্বেগ যথার্থ। কিন্তু প্রধানত ভ্যাটের ওপর আইএমএফের প্রস্তাবিত কৌশলের নির্ভরতা উদ্বেগজনক, যার বৈষম্যমূলক প্রভাব সর্বজনবিদিত।
অন্যদিকে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার, বিশেষ করে মিস ইনভয়েসিং-ভিত্তিক অবৈধ অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সম্ভাব্য পদক্ষেপের কোনো ইঙ্গিত নেই।
ড. জামান বলেন, আইএমএফ দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এই প্রতিষ্ঠান নিজেদের সম্পর্কে যা প্রচার করে, তা অনুশীলনও করবে।
এদিকে, শর্ত মেনে আইএমএফ’র টাকা নেয়ার বিপক্ষে এফবিসিসিআই। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ নেয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের অবস্থা এতটা বেগতিক না যে যাচ্ছেতাই শর্ত মেনে ঋণ নিতে হবে।
গতকাল শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরাম আয়োজিত ‘ইআরএম ডায়ালগ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচনী বছরে টাকা পাচার বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু বলছে আমদানির আড়ালে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্য দেখানোর প্রমাণ পেয়েছে তারা, তাদের উচিত জড়িতদের আইনের আওতায় আনা। তা না হলে কেবল বাহবা নেয়ার জন্য মুখরোচক কথা বন্ধ করা দরকার।
তিনি বলেন, আন্ডার-ইন-ভয়েস ও ওভার-ইন-ভয়েস করে যারা অর্থ পাচার করে তাদের ধরা উচিত। এফবিসিসিআই চায় সরকার এ বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
চলমান মহামন্দায় দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর উক্তি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জসিম উদ্দিন বলেন, দুর্ভিক্ষ হলে শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো পৃথিবীতে হবে। সে হিসেবে বাংলাদেশ এর বাইরে না। এজন্য আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন করা দরকার। এর পাশাপাশি আমাদের কৃষিখাত নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডসহ হালাল খাদ্যপণ্য নিয়ে যারা সফল তাদের অনুসরণ করতে পারে।
তিনি বলেন, ডলার সংকটকে পুঁজি করে কিছু কিছু ব্যাংক স্বল্প সময়ে ১০০-২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা দরকার।
ঋণ কেন প্রয়োজন?
অর্থনীতির একটি ‘বিশেষ অবস্থা’ চলছে৷ বিশেষ করে ডলার সংকট আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ আর এবার বাজেট বাস্তবায়নেও ঋণ সহায়তা প্রয়োজন৷ ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার চলতি বাজেটে মোট ঘাটতি আছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা৷ ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ বৈদেশিক উৎস বাদে বাকি এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা৷
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে আছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এখন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে গেছে৷ ফলে এ দিয়ে পাঁচ-ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব৷ কিন্তু রিজার্ভের প্রধান উৎস প্রবাসী আয়, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কমে ৪৯.৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে৷ রপ্তানি ঠিক থাকলেও আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে৷
গত অর্থ বছরের জুলাই থেকে মে ১১ মাসে আমদানি হয়েছে৭৫.৭ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি৷ এই সময়ে রপ্তানিও বেড়েছে, তবে তা আমদানির তুলনায় কম৷ ৪৪.৪২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে এই সময়ে৷ বেড়েছে ৩৩ শতাংশ৷ গত অর্থ বছরে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১০৩ কোটি ডলার৷ আর তার আগের অর্থ বছরে রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার৷
এদিকে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই৷ বিবিএস-এর হিসেবে সেটা এখন রেকর্ড ৭.৫৬ ভাগ৷
পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ
অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ চার হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ শেষে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আট লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সংখ্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২১ শতাংশ।
বড় ঋণের বেশির ভাগই সরকারের নেওয়া ঋণ, যা শতকরা হিসাবে ৭৩ শতাংশ। আর এসময়ে বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে ২৭ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারি-বেসরকারি খাতে চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
তবে বাংলাদেশের এখন যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে আরও বিদেশি ঋণ লাগবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা৷ বিশেষ করে ডলারের রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বড় আকারের বৈদেশিক ঋণ দরকার৷ আর তাই আইএমএফ-এর চেয়ে বড় কোনো বিকল্প উৎস বাংলাদেশের কাছে নেই৷
মাথাপিছু ঋণ
আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি যে, আজ বা গতকাল যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে তার মাথাপিছু জাতীয় ঋণ কত? আর বাংলাদেশ সরকারই বা জনগণের জন্য মাথাপিছু কত টাকা খরচ করে? বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রনালয় ডেট বুলেটিন নামে একটি প্রকাশনা বের করে, যেখানে সরকার জাতীয় ঋণের তথ্য প্রকাশ করে।
এই ডেট বুলেটিনের সেপ্টেম্বর-২০২১ এর সংস্করণ অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ১০ লাখ ৬ হাজার ২০২ কোটি টাকা ঋণ করেছিল। পরের অর্থবছরে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
আর সরকারি হিসাবে মোট জনসংখ্যা অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় ঋণ দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ৮২২ টাকা। পরের অর্থবছরে তা হয় ৬৮ হাজার ৩১ টাকা।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ