ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকার এক বিজ্ঞানীর নাম হিরাম স্টিভেনস্ ম্যাক্সিম। প্রথম বহনযোগ্য সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান তৈরি করেন তিনিই। এ ছাড়াও জীবদ্দশায় বহু আবিষ্কারের কৃতিত্ব রয়েছে ম্যাক্সিমের।
শুধু মেশিনগান নয়, আরো অনেক আধুনিক যন্ত্রের আবিষ্কর্তা ছিলেন ম্যাক্সিম। তিনি হেয়ার কার্লিং আয়রন, ইঁদুর ধরার কল এবং বাষ্প পাম্পের মতো যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন। ১৮৪০ সালের ৪ নভেম্বর আমেরিকার মেইনের স্যাঙ্গার্সভিলে এক কৃষক পরিবারে ম্যাক্সিমের জন্ম। তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র সারাইয়ের জন্য স্থানীয়দের মধ্যে ম্যাক্সিমের বাবার বিশেষ নাম ছিল।
স্থানীয় একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন ম্যাক্সিম। সেখানে থেকেই তিনি মৌলিক শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ম্যাক্সিম একটি কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন। সেই কারখানায় ঘুরে বেড়াত প্রচুর ইঁদুর। ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল কর্মীদের। ইঁদুরদের জন্য বিস্তর জিনিসপত্রও নষ্ট হচ্ছিল।
ইঁদুরের হাত থেকে কারখানার কর্মীদের মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ম্যাক্সিম। কিছু দিনের মধ্যে তিনি ইঁদুর ধরার জন্য এক যন্ত্র তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেন। কারখানা জুড়ে শুরু হয় তার জয়জয়কার। বর্তমানে সাধারণ গৃহস্থালিতে যে ইঁদুর তৈরির কল দেখা যায়, তার প্রাথমিক নকশা ম্যাক্সিমেরই বানানো।
কয়েক বছরের মধ্যে ম্যাক্সিম আরো বেশ কয়েকটি গ্যাসের যন্ত্রপাতি এবং বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন। ১৮৮১ সালে প্যারিসে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন ম্যাক্সিম। তিনি পরে জানিয়েছিলেন সেই প্রদর্শনীতে তাকে এক ব্যক্তি বলেন, আপনি যদি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে চান তা হলে এমন কিছু আবিষ্কার করুন, যা দিয়ে ইউরোপীয়রা একে অপরকে মারতে উদ্যত হবে। ঐ বছরই ম্যাক্সিম ইংল্যান্ড চলে যান। সেখানে তিনি ব্রিটেনের আদবকায়দা শিখে নিজেকে পুরোদস্তুর ব্রিটিশ নাগরিকে পরিণত করেন।
ব্রিটেনে থাকাকালীন ম্যাক্সিম ঠিক করেন, তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করবেন যা সারা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের রূপ বদলে দেবে। এরপরই স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান তৈরির কাজে হাত লাগান ম্যাক্সিম। কয়েক বছর ধরে চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় এবং বহনযোগ্য মেশিনগান তুলে দেন তিনি।
ম্যাক্সিম দেখেছিলেন বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার পর কার্তুজের খোল ছিটকে বেরিয়ে যায়। একে বলে গুলির ‘রিকয়েল’ শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়েই মেশিনগান তৈরি করেছিলেন ম্যাক্সিম।
ঐ শক্তিকে তিনি এমন ভাবে কাজে লাগান, যাতে একটি কার্তুজের খোল বাইরে বেরিয়ে আসার পর পরবর্তী কার্তুজ নিজে থেকেই বন্দুকে ঢুকে যায়। এর জন্য তিনি কার্তুজের তৈরি বেল্টও তৈরি করেন। ম্যাক্সিমের তৈরি মেশিনগান হাতে পেয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হাতে যেন স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিল। রাইফেল ব্যবহার করে যেখানে মিনিটে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোড়া যেত, সেই জায়গায় মেশিনগানের গুলি ছোড়ার ক্ষমতা মিনিটে ৫০০ রাউন্ড। অর্থাৎ ১০০ গুণ!
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ম্যাক্সিমকে ঐ মেশিনগান আরো আধুনিক ভাবে বানানোর নির্দেশ দেয়। ১৮৮৯ সালে সেই অত্যাধুনিক মেশিনগান ব্রিটিশ বাহিনীকে দিয়েছিলেন ম্যাক্সিম। বিশ্ব জুড়ে ম্যাক্সিমের বানানো মেশিনগান নিয়ে হইচই পড়ে যায়। ১৯৯০-এ অস্ট্রিয়া, জার্মান, ইতালি, সুইডেন এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনীও ম্যাক্সিমের তৈরি স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানের স্বত্ব কিনে নেয়। ১৮৯৩-’৯৪ সালে ‘মাতাবেলে যুদ্ধে’ ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক বাহিনী প্রথম এই মেশিনগান ব্যবহার করেছিল।
ব্রিটেনের মাত্র পঞ্চাশ জনের সেনাদল ম্যাক্সিমের বানানো মাত্র চারটি মেশিনগান দিয়ে পাঁচ হাজার মাতাবেলে যোদ্ধাদের হারিয়ে দিয়েছিল। মেশিনগান তৈরির জন্য ক্রেফোর্ডে একটি অস্ত্রের কারখানা তৈরি করেন ম্যাক্সিম। ১৮৯৬ সালে ম্যাক্সিমের এই কারখানা কিনে নেয় ‘ভিকার্স কর্পোরেশন’ নামে এক সংস্থা। ১৯০১ সালে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ম্যাক্সিমকে নাইট উপাধি দেন ব্রিটেনের তৎকালীন শাসক রানি ভিক্টোরিয়া। ব্রিটেন-সহ বহু দেশের সামরিক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করলেও মেশিনগানের আওয়াজ ছিল বিকট। সারা জীবন সেই আওয়াজের মধ্যে কাজ করতে করতে বধির হয়ে যান ম্যাক্সিম।
১৯১৬ সালে ২৪ নভেম্বর লন্ডনের স্ট্রেথামে ম্যাক্সিমের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৬। মৃত্যুর আগে বন্দুকের সাইলেন্সার, ধোঁয়াবিহীন বারুদ এবং কার্বন ফিলামেন্ট আবিষ্কার করেন ম্যাক্সিম। নিজে দীর্ঘ দিন ব্রঙ্কাইটিসে ভুগেছিলেন। তাই প্রতিকার হিসাবে ইনহেলারও আবিষ্কার করেন তিনি। সারা জীবনে আমেরিকার কাছ থেকে ১২২টি এবং ব্রিটেনের কাছ থেকে মোট ১৪৯টি স্বত্ব পান ম্যক্সিম। জীবনের শেষের দিকে, বিমান নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন তিনি। তৈরি করেছিলেন বিমানের মডেলও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ