ইতিহাসের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। লুক্রেসিয়ার কথা হয়ত আমরা ভুলে গেছি। আড়াই হাজার বছর আগের কথা, কে মনে রাখবে লুক্রেসিয়াকে! তবে আমরা নিশ্চয় ভুলিনি যে অতি শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটেছিল। আর সেই পতনের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে লুক্রেসিয়ার নাম। বলা হয়, রোমান সাম্রাজ্যের শেষ রাজার গুণধর পুত্র লুক্রেসিয়াকে ধর্ষণ করেছিল। লুক্রেসিয়া মনে করে এই জঘন্য অপরাধ তার এবং তার পরিবারের সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে। সে বিচার চায়। তার প্রার্থনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় যা তার সম্মানকে আরও কলুষিত করে। তবে লুক্রেসিয়া তাদের সেই সুযোগ বেশি সময় দেননি। বিতর্ক চলাকালে সে একটা ছুরি নিজের বুকে বসিয়ে দেয়; লুক্রেসিয়া আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় জনগণের ভিতর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা ক্ষুব্ধ হয়। এমনটাও বলা হয় যে ব্রুটাস তখন লুক্রেসিয়ার বুকে বিদ্ধ ছুরি বের করে প্রতিজ্ঞা করেন লুক্রেসিয়ার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার। নানা অন্যায় অবিচার এবং শোষণ নির্যাতনে ক্ষুব্ধ জনগণ ব্রুটাসকে সমর্থন জানায়। শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিপ্লব। রোমান সেনাবাহিনীও জনগণের বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। পতন ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের। ধর্ষণ, নারীর প্রতি অসম্মান ইতিহাসে তাবড়-তাবড় যুদ্ধের কারণ। তবে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি। এখনও হচ্ছে ধর্ষণ। এমনকি পরবর্তীতে ধর্ষিতার চরিত্র হননও হচ্ছে জেরার মুখে। তবে এবার এই প্রহসন থেকে মুক্তি পেতে চলেছে বাংলাদেশ।
আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তার চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না; এমন বিধান যুক্ত করে ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে সংসদে৷ এছাড়া বিচার কাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ, এই আইনে যোগ করা হয়েছে৷
এসব বিধান যুক্ত করে বৃহস্পতিবার ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়৷ সূত্র মতে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন৷ বিলের উপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন স্পিকার৷
অনেক আগে থেকেই নারী আন্দোলনের কর্মী এবং অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষ্য আইন সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিল৷ তারা বলছিল, এই আইনের কিছু ধারা নারীর প্রতি অবমাননাকর৷
সংসদে বিরোধী দলের বেশিরভাগ সদস্যই আইন পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রশংসা করেন৷ তবে ডিজিটাল তথ্যকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের ধারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা, যিনি নিজেও একজন আইনজীবী৷
কী আছে এই সংশোধনীতে?
এই সংশোধনী পাস হওয়ার ফলে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে৷ এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা৷
বিলে ক্রস এক্সামিনেশন বা জেরার সময় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে৷ তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার ভিকটিমকে তার নৈতিক চরিত্র বা অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না৷ ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি আদালত মনে করে এই ধরনের প্রশ্ন করা প্রয়োজন, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়েই কেবল তা করা যাবে৷
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ঔপনিবেশিক আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন৷ এছাড়া সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও নতুন ধারা যুক্ত করে মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনেরও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে৷
এতে বলা হয়েছে, কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে, আদালত যদি মনে করে যে কোথাও আপত্তিজনক কিছু আছে অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য-প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে৷
কেন ব্রিটিশ আমলের আইন এখনও?
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) এবং ১৪৬(৩) ধারা এখন আলোচনার কেন্দ্রে। এই দুইটি ধারায় ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। ১৫৫(৪) ধারায় নারীর সাক্ষ্য নেয়ার সময় সরসরি তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র, তার অতীত যৌন জীবন, সম্পর্ক সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।
এসব প্রশ্ন করে নারীকে শুধু মানসিকভাবে দুর্বলই নয়, তাকে খারাপ চরিত্রের বলে প্রমাণের চেষ্টা করে ধর্ষণ মামলার আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করার সুযোগ ওই আইনে দেয়া আছে। আর ১৪৬(৩) ধারায় জেরার সময়ও নারী ও পুরুষ উভয়কে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। তবে আইনজীবীরা এটা নারীর ওপরই প্রয়োগ করেন।
বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের এই দুইটি ধারা প্রকারান্তরে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র হননের সুযোগ করে দিয়েছে। তার সুযোগ নেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। এই দুইটি ধারা ব্রিটিশ আমলের। এই আইন ধর্ষণ মামলার বিচারে বড় বাধা। কারণ, আইন দুইটির কারণে ঘটনা বাদ দিয়ে আদালতে আইনজীবীরা নারীর চরিত্র হননে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারণ, দুশ্চরিত্রা প্রমান করতে পারলে আইনে আসামি সুবিধা পান। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে নারীকে নতুন মামলার ফাঁসিয়ে দেয়ারও সুযোগ আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের এই দুইটি ধারার সুবিধা নিয়ে আসামির আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার নারীকে এক অর্থে দ্বিতীয়বার আদালতে মৌখিকভাবে ধর্ষণের সুযোগ নেয়, যা একজন নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়া নারীকে আরো গভীর ট্রমায় নিয়ে যায়। এই দুইটি আইন বাতিল হলে আদালতে নারীকে নতুন করে হেনস্থা হতে হবে না। ধর্ষণের মামলা প্রমাণও অনেক সহজ হবে।
ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, যৌন হয়রানির ঘটনা আমাদের দেশে হরহামেশায় ঘটছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার সংখ্যা অতি নগণ্য। যে কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না! নির্যাতনের শিকার হয়ে অপমানে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রতিটি ঘটনা সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি আমাদের রাষ্ট্রর ক্ষমতা ও আইনি কাঠামোতে। আমাদের আইনি কাঠামো এখনো জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন এবং দণ্ডবিধিতে যেমন ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলা হচ্ছে তেমনি রাষ্ট্র এখনো ধর্ষণকারীর প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে।
ব্রিটিশরা চলে গেছে সাত দশক হলো। পাকিস্তানিদের শোষণ যাঁতাকল থেকেও মুক্ত হয়েছি আমরা সেও সাড়ে চার দশক আগে। স্বাধীন বাংলাদেশে কার স্বার্থে সাক্ষ্য আইনে অমন বিধান আমরা বহাল রেখেছি?
ধর্ষক ও যৌন হয়রানিকারীরা কোনো ধর্ম মানে না, কোনো আইন মানে না। তারা যেমন অসুস্থ; তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজ যে দৃষ্টিতে ধর্ষণ ঘটনাকে দেখে সেটাও সুস্থ কোনো কিছু ইঙ্গিত করে না। রাষ্ট্র দুই একটা আইনি বিধান করেই তার দায়িত্ব শেষ করতে চাইছে। আবার যাদের উপর সেই আইন প্রয়োগের ভার দেয়া হয়েছে তাদের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার, যা অতি জরুরি।
লুক্রেসিয়ার আত্মহনন রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেছিল। কোনো একটি ঘটনাকে ধরে আমাদেরকেও বিচারহীনতার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক ভেদাভেদ নেই। রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্র কোনোভাবেই একজন ধর্ষণকারীকে রক্ষা করার চেষ্টা করে নিজেকে কলুষিত করতে পারে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ