সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।
এদিকে দেশের প্রবাহে মিশে যাওয়ার জন্য লাখ টাকা খরচ একেকজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি হয়ে যাচ্ছেন।
খুনাখুনি বাড়ছেই
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইরানি পাহাড়ে আবারও দুই রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।
বুধবার দিনগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ১৭নং ক্যাম্পের মেইন ব্লক-সি, সাব ব্লক-এইচ/৭৬ এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
গুলি করে দুজনকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক এডিআইজি সৈয়দ হারুনুর রশিদ।
নিহতরা হলেন— ১৭নং ক্যাম্পে আশ্রিত কেফায়েত উল্লাহর ছেলে আয়াত উল্লাহ (৪০) এবং মো. কাসিমের ছেলে ইয়াছিন (৩০)।
এডিআইজি সৈয়দ হারুনুর রশিদ বলেন, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ইরানি পাহাড়ে একদল অজ্ঞাতনামা ও অস্ত্রধারীরা দুজন রোহিঙ্গাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এতে গুলিবিদ্ধ ইয়াছিন ঘটনাস্থলে মারা যান। অপর গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা আয়াতউল্লাহকে উদ্ধার করে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতাল নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকেও মৃত বলে ঘোষণা করেন।
তিনি আরও বলেন, কারা এবং কেন এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে এখনো জানা যায়নি। এ ঘটনার পর ক্যাম্পে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে এপিবিএন পুলিশ।
এদিকে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের কারণে ক্যাম্পজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বুধবার ভোরেও পৃথক ঘটনায় দুজনকে গুলি করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন একজন। অপরজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ নিয়ে চলতি মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই জন মাঝি ও এক শিশু সহ ৭ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
লাখ টাকায় রোহিঙ্গা হয়ে যাচ্ছেন ‘বাংলাদেশি’!
চট্টগ্রামে জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের পাঁচ ডাটা এন্ট্রি অপারেটরসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশ বলছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিস্তৃত এই চক্রটি মাত্র এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় একজন রোহিঙ্গার কাছে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় বিক্রি করছিলো। সরাসরি ইসি’র চলমান কার্যক্রমের আওতায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হয় এবং এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- নির্বাচন কমিশনের চুক্তিবদ্ধ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. নুর নবী ওরফে রাহাত (২৫), মো. মিজানুর রহমান (২৩), ফরহাদুল ইসলাম (২৮), ইমন দাশ (২০), মো. কামাল (৪২) এবং মো. কামাল হোসেন ওরফে মোহাম্মদ (৪৫), পারভীন আক্তার (২৫), মো. নুরুল আবছার (২৮), শামসুর রহমান ওরফে শামসু মাস্টার (৬০), মো. ইয়াছিন আরাফাত (২২)।
উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আলী হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকালে নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকার বি-ব্লকে হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চ বিদ্যালয়ে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলছিল। পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পায়, সেখানে কক্সবাজার থেকে দু’জন রোহিঙ্গা ভোটার হতে এসেছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা কামাল ও পারভীনকে আটক করা হয়।
মাত্র এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় একজন রোহিঙ্গার কাছে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় বিক্রি করছিলো। সরাসরি ইসি’র চলমান কার্যক্রমের আওতায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হয় এবং এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, শামসুর রহমান ও নুরুল আবছার তাদের ভোটার করার জন্য হালিশহরে এনেছেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর বহদ্দারহাটে তাদের অবস্থান শনাক্ত করে দু’জনকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও মোবাইলে থাকা তথ্য যাচাই-বাছাই করে পাঁচজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে আটক করা হয়। কামাল নামে এক অটোরিকশা চালক রোহিঙ্গা দু’জনকে হালিশহরে নিয়ে যান, তাকেও আটক করা হয়।
আসামি শামসু মাস্টার কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে আসামি নুরুল আবছারের কাছে পাঠাতো। পরে নুরুল আবছার ওই রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দিতো। এই কাজে তাকে সহায়তা করতো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৫ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। এই চক্রটি দীর্ঘদিন বিভিন্ন প্রকার জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এনআইডিসহ বিভিন্ন প্রকার ডকুমেন্ট তৈরি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল।
তিনি বলেন, ’শামসুর ও আবছারের সঙ্গে চট্টগ্রামে ইসি’র চলমান প্রকল্পে যুক্ত আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা কয়েকজন কর্মচারীর যোগাযোগ আছে। আবছারের মোবাইলে ৫০০ রোহিঙ্গার জন্ম নিবন্ধন সনদের ছবি পাওয়া গেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা এবং ঢাকার নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের যোগসাজশের তথ্য পেয়েছি। নির্বাচন কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মীর নামও পেয়েছি, তবে আমরা নিশ্চিত নই যে তারা জড়িত।’
ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের আরও বিভিন্ন স্থানে এই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো হচ্ছে বলে সন্দেহ ডিবি কর্মকর্তাদের। আটক ১০ জনের বিরুদ্ধে এনআইডি নিবন্ধন আইনে ও দুই রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৈদেশিক নাগরিক আইনে নগরীর হালিশহর থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) শামীম কবীর।
শামীম কবীর বলেন, ‘এই কাজে শুধু কয়েকজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর জড়িত, এমন নয়। আমরা নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েরও কয়েকজনের নাম পেয়েছি, যারা সার্ভারে তথ্য ইনপুট দেন। সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। রোহিঙ্গাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের একটি নিবন্ধন ফরম পাওয়া গেছে। সাধারণত এই ফরম নির্বাচন কর্মকর্তা ছাড়া আর কারও কাছে পাওয়ার কথা নয়। আমরা তথ্য পেয়েছি, সাদ্দাম নামে একজন এই ফরম আবছারকে দিয়েছে। সাদ্দাম হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে কর্মরত আছেন বলে জানতে পেরেছি।’
এর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে লাকী আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা নারী ভুয়া এনআইডি সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে পাসপোর্ট নিতে গিয়ে ধরা পড়ার পর জালিয়াত চক্রের খোঁজে নামে নির্বাচন কমিশন। সে সময় রোহিঙ্গা সন্দেহে অর্ধশত এনআইডি বিতরণ আটকে দেয় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগ।
ওইসময় এনআইডি জালিয়াতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন, এনআইডি উইংয়ের কর্মী শাহনূর মিয়া, অস্থায়ী কর্মী মোস্তফা ফারুক, মো. শাহীন, মো. জাহিদ হাসান এবং পাভেল বড়ুয়াসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে তৈরি করেছে অপরাধী গ্রুপ। তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এতে প্রায়ই খুন, সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটছে অপহরণের মতো ঘটনাও। এ ছাড়া ধর্ষণ, ডাকাতির ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবার আখড়ায় পরিণত করেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টেও পরিণত হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৪
আপনার মতামত জানানঃ