মহামারী ঠিক কী, সেটা কেমন রূপ ধারণ করতে পারে তা করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্ব দেখে নিয়েছে। যদিও এখনও অবধি করোনা মহামারীর হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে নিস্তার পাওয়া যায়নি। এর মাঝেই নতুন মহামারী পূর্বাভাস দিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই মহামারী কোনও বাদুড় কিংবা অন্য কোনও পশু থেকে আসবে না। পরবর্তী ‘ভাইরাল’ মহামারীর জন্য দায়ী থাকবে হিমবাহের গলন। শুনতে অবাক লাগছে? কিন্তু এমনটাই দাবী জানাচ্ছে প্রসিডিংস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি: বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা।
করোনা পরবর্তী ভাইরাসজনিত ভয়াবহ নতুন মহামারীর উৎস হতে পারে হিমবাহের গলন। অতিরিক্ত হারে বরফ গলনের ফলে তাতে নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাতে থাকে ভাইরাসের নতুন ‘হোস্ট’ খুঁজে নিয়ে, তাকে সংক্রামিত করার প্রবণতা। বৈজ্ঞানিকভাবে যার নাম ‘ভাইরাল স্পিলওভার’।
নতুন গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে নতুন ‘হোস্ট’ খুঁজে নিয়ে কোনও ভাইরাস সেটিতে সংক্রামিত হতে পারে এবং তার দ্বারা পরবর্তীতে অন্য ‘হোস্ট’কেও সংক্রামিত করতে পারে।
বর্তমানে যে হারে হিমবাহ গলছে, তাতে জমা পানির সঙ্গে এসে মিশছে প্রচুর ভাইরাস এবং ব্যাকটিরিয়া। সেই পানি সেবন করে বন্যপ্রাণীরা যেমন সংক্রামিত হতে পারে, তেমনই তাদের মাধ্যমে মানুষেরও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
ঠিক যেমন ভাবে কোভিড সংক্রমণের নেপথ্যে রয়েছে বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্ব। বিজ্ঞানীদের যে দলটি এটা দাবি করেছে, তারা বিশ্বের বৃহত্তম ‘হাই আর্কটিক’ মিষ্টি পানির হ্রদ ‘লেক হ্যাজেন’ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি: বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’ নামের জার্নালে।
এই গবেষণাটি ২০২১ সালে করা হয়। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ৩৩টি ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন যা ১৫,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হিমায়িত ছিল। এই ৩৩টি ভাইরাসের মধ্যে ২৮টি নতুন ভাইরাস মিলেছে ওই জলে। আর এই নতুন আবিষ্কৃত ভাইরাসগুলি তিব্বতের হিমবাহে পাওয়া গেছে, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে গলে যাচ্ছে।
২০১৬ সালে উত্তর সাইবেরিয়ায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এতে এক শিশু মারা যায় এবং সাতজন আক্রান্ত হয়। তাপমাত্রার প্রভাবে পারমাফ্রস্ট গলে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি ছড়ায় বলে দাবি করে আসছে বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, মাইক্রোবায়োম জার্নালের ২০২১ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী প্রায় ১৫,০০০ বছর ধরে তিব্বতের মালভূমির হিমবাহগগুলির বরফের মধ্যে দিব্বি টিকে আছে বেশ কিছু ভাইরাস, যেগুলির অধিকাংশই আমাদের অজানা। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের কারণে ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫০ বছরে এই অঞ্চলের প্রায় এক চতুর্থাংশ বরফ গলে গিয়েছে। কাজই মানব সভ্যতায় এই ভাইরাসগুলির এসে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
গবেষকদের অনুমান, বরফের নমুনায় পাওয়া এই ভাইরাসগুলির প্রায় অর্ধেকই বেঁচে আছে স্রেফ বরফের উপস্থিতির কারণেই। আরেক গবেষক তথা ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মাথি সালিভান জানিয়েছেন, ভাইরাসগুলির জিনে এমন চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে, যা তাদেরকে হিমশীতল পরিবেশেও কোনও জীবিত কোষকে সংক্রমিত করতে সহায়তা করে। এই জেনেটিক স্বাক্ষরের জন্যই তারা ওই চরম অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, এই বরফের মধ্যে আটকে থাকা ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবাণু সম্পর্কে বিজ্ঞানের জানা খুবই কম। সেখানে কী কী বিপদ লুকিয়ে রয়েছে তা কেউ জানে না। ক্রমে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে দুই মেরু প্রদেশ এবং তৃতীয় মেরু হিসাবে পরিচিত এই তিব্বতি মালভূমির হিমবাহগুলির বরফ গলছে। নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি নতুন হলেও, করোনাভাইরাস পরিবারটি মানব সভ্যতার কাছে অপরিচিত ছিল না। তার নতুন সদস্যের মোকাবিলা করতেই গত দেড়বছর ধরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। বরফ গলে গিয়ে যদি এই সম্পূর্ণ অচেনা ভাইরাসগুলির সংস্পর্ষে আসে মানুষ, তাহলে কী হতে পারে, তা কল্পনা করাই যায়।
তাই, ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, এই ভাইরাসগুলির ডকুমেন্টেশন এবং এগুলিকে নিয়ে গবেষণা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস জলবায়ু পরিবর্তনে কীভাবে সাড়া দেয়? বরফের যুগে থেকে বিশ্বউষ্ণায়নের সময়ে আসলে কী ঘটে, সেগুলি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন।
এসডব্লিউএসএস১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ