গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনার হিড়িক শুরু হয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ খাতের ক্রমান্বয়ে ভারতমুখী করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতবড় একটি জরুরি ও জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তাতে স্বনির্ভরতার গতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। বিদ্যুৎ সেক্টরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভিন্ন দেশের প্রভাব নিজ দেশে মারাত্মক ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। এই অবস্থা মোকাবিলায় এখন থেকেই আগাম কর্মকৌশল নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যুৎখাত পুরোপুরি ভারত নির্ভর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশ ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। আগামী ডিসেম্বরে ভারতের আদানি গ্রুপের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের দাম এবং ভারতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে বলেও মনে করেন অনেকে।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্ত ছিলো যে তুলনামূলক কম দামে বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে জ্বালানি খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে কিনা সে নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে এখন যা আমদানি করা হচ্ছে এবং ডিসেম্বর নাগাদ ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে যে বিদ্যুৎ পাবে সেটি যৌক্তিক দামেই থাকবে। তবে এরপর আর আমদানি করা হবে কিনা সেটি সম্পর্কে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন দেশে ব্যয়বহুল কিংবা অযৌক্তিক বেশি ব্যয় হয় এমন কেন্দ্র ছাড়াও কুইক রেন্টাল কিংবা পুরনো হয়ে পড়া কেন্দ্রগুলো বন্ধ না করলে আমদানি করা বিদ্যুতের ভারসাম্যপূর্ণ যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। ফলে এক পর্যায়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বোঝা হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রবল।
প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র বাংলাদেশকে দেয়ার উদ্দেশে ভারতের ঝাড়খণ্ডে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে আদানি গ্রুপ। তবে অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কয়লা-ভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে এখানে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
সমস্যা যেখানে
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ডঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, সরকারের হাতে এলএনজি ও ডিজেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। এ প্রেক্ষাপটে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ দিয়ে ঘাটতি মেটাতে পারলে সেটা মন্দের ভালো হবে।
“তবে এটি হতে পারে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে। মোটা দাগে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখলে ক্যাপাসিটি পেমেন্টে দিতে হবে বিপুল পরিমাণ। সে কারণে আমদানির যে চ্যালেঞ্জ তাকে যৌক্তিক পর্যায়ে যেতে হলে দেশে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল কেন্দ্রগুলো কিংবা কুইক রেন্টালের অবসান ঘটাতে হবে। তাহলেই আমদানি করা বিদ্যুতের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং এটিকে বোঝা মনে হবে না।”
তবে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে না এলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎ খাত
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতার কথা জোরেশোরে বলা হলেও এখনো দেশটির উৎপাদন ক্ষমতার বড় একটি অংশ নির্ভর করছে আমদানি করা জ্বালানির ওপরে। কারণ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা তেল, কয়লা বা গ্যাসের একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়।
সরকারের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে, তাতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বাকী ত্রিশ শতাংশ তেল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে।
কিন্তু এর কোনটার জ্বালানি পুরোপুরি দেশীয় উৎস থেকে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, তেল বা কয়লার দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে।
অন্যায্য ক্যাপাসিটি চার্জ
জুনে স্টেট ওয়াচে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানি গ্রুপের দুটি ইউনিটে ১৫০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ২৫ বছর মেয়াদে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নেবে। এ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশি নাগরিক সমাজের জোট বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) ও ভারতীয় গ্রোথওয়াচের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে এ বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৭ সালে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে, বছরে যার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির এ বিদ্যুৎ আমদানির কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে শীতে এ চাহিদা সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। আবার সন্ধ্যার তুলনায় দিনে চাহিদা অনেকখানি কমে যায়। তাই উচ্চ ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত পুরোই অযৌক্তিক। বিদ্যমান বিদ্যুতের উপযুক্ত ব্যবহার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগস্ট মাসে উৎপাদন শুরু করবে, যদিও সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েই আদানি গ্রুপকে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে।
এ সম্পর্কে প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ‘যে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া দেওয়া হবে তার পরিমাণ কর্ণফুলী টানেলের মোট বাজেটের নয়গুণ এবং ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের চারগুণেরও বেশি।’
দুর্নীতিতে পঙ্গু বিদ্যুৎখাত
২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ছিল ১০ শতাংশের কম, ২০৩০ সালে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে হবে ৭০ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এটা ৯০ শতাংশও হতে পারে।
সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা, তার জন্য জ্বালানি (মূলত বিদেশি কয়লা, বিদেশি তেল, বিদেশি এলএনজি ও গ্যাস) খরচ বেড়ে দাঁড়াবে বর্তমান অর্থমূল্যে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতা গ্রহণকালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৪,৯৪২ মেগাওয়াট। আর বিদ্যুৎসুবিধাভুক্ত মানুষ ছিল ৪৭%। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু দুর্গম এলাকা ব্যতীত দেশের সর্বত্রই বিদ্যুতায়ন হয়ে ৯৭% মানুষ বিদ্যুৎসুবিধাভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও মানুষের বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিরবচ্ছিন্ন হয়নি। লোডশেডিং চলছে ব্যাপক! বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে। রাজধানীতেও দিনে কয়েকবার করে লোডশেডিং হচ্ছে প্রতিদিনই।
মানুষের গড় বিদ্যুৎপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে দেশের অবস্থান তলানিতে! অন্যদিকে, সক্ষমতা অনুযায়ী সব বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারায় ৫৮% বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা করে। তাই ভর্তুকি বেড়েই চলেছে, যা কমানোর জন্য গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম পাইকারিতে ১১৬% ও গ্রাহকের ৯০% বাড়ানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ