ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারার দোহাই দিয়ে জারিকৃত তথ্য পরিকাঠামো প্রজ্ঞাপন প্রতারণামূলক। সাংবাদিক সমাজ এটা প্রত্যাখ্যান করছে। এক বিবৃতিতে এসব জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
তারা আরও জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা সরকারের দুরভিসন্ধি ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের নতুন হাতিয়ার। তারা এই প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
সোমবার(১০ অক্টোবর) বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন এবং ডিইউজের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা বলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করবে। এই প্রজ্ঞাপন তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে যে ভীতি-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, এই অপতৎপরতার নেপথ্যে যে সরকারের অসদুদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি রয়েছে, ঠান্ডা মাথায় তালিকা যাচাই করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তালিকায় রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, অডিট (নিরীক্ষা) বিভাগ, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম নেই। আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
২৯ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। যেগুলো নির্বাচনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে। সাংবাদিকেরা যেন এ-সংক্রান্ত কোনো সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে না পারেন, সে জন্যই এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যমের ওপর এটি আরেকটি খড়্গ।
বিবৃতিতে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতে অনতিবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সাংবাদিকদের অর্থদণ্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইনের সংশোধনীর উদ্যোগ বন্ধের দাবি জানানো হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ধারা ১৫ অনুযায়ী সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করে গত ২১ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। আইসিটি বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করে।
সাংবাদিকেরা যেন এ-সংক্রান্ত কোনো সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে না পারেন, সে জন্যই এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যমের ওপর এটি আরেকটি খড়্গ।
তথ্য পরিকাঠামো হলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক, যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। বেআইনিভাবে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন বা ক্ষতির চেষ্টা করলে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডই দেওয়া যাবে।
আইসিটি বিভাগ বলছে, এই তথ্য পরিকাঠামোয় জনগণের তথ্যপ্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটবে না। তবে এই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর তালিকা নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ব্যাখ্যায়ও অস্পষ্টতা কাটেনি বলে জানিয়ে প্রজ্ঞাপন সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনটি এ দাবি জানিয়েছে।
সংস্থাটির মতে, এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে। এর প্রেক্ষিতে আইসিটি বিভাগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গত রোববার ব্যাখ্যা দেয় যে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো তথ্য প্রাপ্তির অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
বিবৃতিতে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, আইসিটি বিভাগের ব্যাখ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো নিয়ে অস্পষ্টতা কাটেনি।
টিআইবি বলছে, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো, অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তবে প্রজ্ঞাপনে তথ্য কাঠামোর নামে পুরো প্রতিষ্ঠানকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ কারণেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ১৬(৩) এর বিধানের আওতায়, প্রজ্ঞাপনে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো প্রকার তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ ও মত প্রকাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বিবেচনায় ‘হুমকিস্বরূপ ও ক্ষতিকারক’ বিবেচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। তাই প্রজ্ঞাপনটি সংশোধন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর শুধুমাত্র কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্ককে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা যৌক্তিক বলে মনে করে টিআইবি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৮
আপনার মতামত জানানঃ