‘আপনারা একটা জিনিস জানেন, আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে একসময় অনেক হিন্দু ছিল অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল। এখানে যারা উচ্চ সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন তারা সব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছেন, আর যত নিকৃষ্টগুলা এখানে থেকে গেছেন।’
– বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাব আহম্মেদ (২৩শে জুলাই, ২০২২; সূত্র: নিউজবাংলা২৪)
ক্ষমতাসীন দলের নেতার এই বক্তব্য অনেককিছুই স্পষ্ট করে দেয়। অনেক প্রশ্নের সামনে উত্তরের দরজা খুলে দেয়। তবু কিছু প্রশ্ন উত্তর জানা সত্ত্বেও বারবার করতে হয়। উত্তরের জন্য নয়, অস্তিত্বের জন্য। আর সেগুলো হল- মুসলিমরা নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করতে পারলে, দূর্গাপুজোয় কেন হিন্দুদের আতঙ্কে থাকতে হবে? কেন কড়া পাহারায় পুজো হবে? কেন থাকবে হামলার শঙ্কা, প্রতিমা ভাঙার উৎকণ্ঠা? কেন এই দেশ আজও উপলব্ধি করতে পারেনি যে, পুলিশি পাহারা দিয়ে যেমন সাম্প্রদায়িকতা কমানো যায় না, সম্প্রীতিও বাড়ানো যায় না?
পুজোয় ধুপধুনোর গন্ধের সাথে মিশে থাকে আতঙ্কের ঘ্রাণ। যে আতঙ্ক টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দূর করতে পারে না। পারে না ফোর্বসের ১০০ জন ক্ষমতাধর নারীর বার্ষিক তালিকায় ৪৩তম (২০২১ সাল) স্থানে থাকা শেখ হাসিনাও। কিন্তু কেন? এই অপ্রতিরোধ্য সাম্প্রদায়িক শক্তির শেকড় কারা? এরা কি রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী? গত প্রায় ১৩ বছরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে ব্যর্থ একটা সরকার পুলিশ বাহিনীর পেছনে আর কত মুখ লুকাবে?
যদিও মানুষ দাবি করবে, এদেশ অসাম্প্রদায়িক। হয়তো আমিও। হয়তো আমার মুসলিম সহকর্মীর দিকে সহজ হেসে তাকাবো। শারদীয় শুভেচ্ছা বিনিময় করবো। কিন্তু গত বছর দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে যে ১৫টি জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে, ভাঙচুর করা হয় শতাধিক মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘর; ওই গ্রামের হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষগুলোর দিকে কি আমি এতোটাও সহজভাবে তাকাতে পারবো! জানাতে পারবো শারদীয় শুভেচ্ছা!
দূর্গাপুজো দেশের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আর বরাবরই দেখা যায় দুর্গাপুজো এলেই প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে দেশের বিভিন্নস্থানে। এবারও বেশকিছু জায়গায় মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এবারও পুজো শুরুর ঠিক দু’দিন আগে পুজোমণ্ডপে জঙ্গি হামলার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ডিএমপি কমিশনার। ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এই শঙ্কার কথা জানালেন। জানা যায়, বেশকিছু পুজোমণ্ডপ ঝুঁকিতে রয়েছে। ৫০ যুবক জঙ্গি হামলার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে হামলার জন্য ট্রেনিংও করছে।
তবু আমরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকবো। বলবো, এদেশ অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। যারা এই মাছ ঢেকে রেখে বিড়ালের জন্য অপেক্ষা করেন, তাদের জন্য একটা পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া প্রয়োজন। চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ১৩ জনকে ধর্ষণ, ১০ জনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। সংগঠনটির মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক জানান, এই সময়ে আরও ৬২০ জনকে হত্যার হুমকি, ১৪৫ জনকে হত্যার চেষ্টা, ১৮৩ জনকে জখম-আহত ও ৩২ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
পাশাপাশি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৬৮টি বসতবাড়ি হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট, ৩৪৩টি অগ্নিসংযোগ, ৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ২ হাজার ১৫৯ একর ৩৬ শতাংশ ভূমি দখল এবং ৪১৯ একর ৬৩ শতাংশ দখলের তৎপরতা চালানো হয়েছে। ঘরবাড়ি দখল হয়েছে ১৭টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৯টি, মন্দিরের জমি দখল ২৯টি, বসতবাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে ১৩২টি। এ ছাড়া ৭১৭টি পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা, ৮ হাজার ৯৪৩টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি, ১৫৪টি পরিবারকে দেশত্যাগের বাধ্যকরণ, ৩ হাজার ৮৯৭টি পরিবারকে দেশত্যাগে হুমকির শিকার এবং ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৯টি পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
কী? আপনার সাম্প্রদায়িকতার বেলুন কি চুপসে গেছে? যদি এখনো না যায়, এবার আসুন এবারের দূর্গাপুজোর নিরাপত্তা বিষয়ক পরিস্থিতি আর শর্তগুলো দেখা যায়। এবার পুজোমণ্ডপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়াও ২৪ ঘণ্টা আনসার বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা নজরদারি করবেন। সব পুজোমণ্ডপে বাধ্যতামূলকভাবে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। এমন জায়গায় পুজোমণ্ডপ করা যাবে না, যেখানে গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। পুজোমণ্ডপের স্বেচ্ছাসেবকদের বাধ্যতামূলকভাবে হাতে আর্মব্যান্ড পরতে হবে। পুজোয় যেকোনো ধরনের গুজবের ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখা হবে। বিশেষ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং করা হবে। কোনো ধরনের গুজব ছড়ানোকে কঠোর হাতে দমন করা হবে। পুজোর সময় পুলিশ সদর দপ্তর এবং জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। আজানের সময় পুজোমণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখতে বলা হয়েছে।
এত বেশিই নিরাপত্তার প্রয়োজন যে আইনপ্রয়োগকারী সদস্যের সংখ্যা কম পড়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারা নির্দেশনা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমরা মনে করছি, আইনপ্রয়োগকারী সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো কঠিন হবে’। এখানেই শেষ না। সূত্র মতে, নিরাপত্তা রক্ষায় আনসার সদস্য বাড়ানোর জন্য সরকার বাড়তি অর্থও বরাদ্দ দিতে পারবে না। পুজো উদ্যাপন পরিষদও এ নিয়ে তাদের আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। একটি ধর্মীয় উৎসবে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব, কেবল সরকারেরই। সেখানে একটি উন্নয়নশীল দেশের পুজোপার্বণ নির্বিঘ্নে পালনে নিরাপত্তাকর্মী দেয়ার মতো ব্যয়ের সক্ষমতা নেই, এটা কি মেনে নেবেন আপনি?
সূত্র মতে, দুর্গাপুজো নিয়ে ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে পুজো উদ্যাপন পরিষদ। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট দিয়েছে পঁচিশ দফা নির্দেশনা। সরকার এর বাইরে বেশকিছু নিরাপত্তা নির্দেশনা দিয়েছে। একটি উৎসবে যদি দফায় দফায় এমন নির্দেশনা যুক্ত হতে থাকে তাহলে উৎসবের প্রাণ থাকে কোথায়?
এক্ষেত্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের বক্তব্যটা উল্লেখ করা যায়। তার ভাষায়, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন তার মানে হলো পুলিশ আছে, পুজো আছে। পুলিশ নেই, পুজোও নেই। এরকম পরিস্থিতি তো আমরা চাই না। পুলিশ পাহারা দিয়ে যদি পুজো উদ্যাপন করতে হয়, তাহলে পরিস্থিতি কেমন তা বোঝাই যাচ্ছে। হ্যাঁ আসলেই বোঝা যাচ্ছে। আর আপনি যদি না বোঝেন, তাহলে আপনিই সেই ব্যক্তি যে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে বিড়ালের জন্য অপেক্ষা করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ