জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি। এরইমধ্যে রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠছে রাজনৈতিক দলগুলো। ঢাকাসহ সারা দেশে নিয়মিতই সভা-সমাবেশ করে আসছে বিএনপি অন্যদিকে বিএনপি’র সঙ্গে প্রায় দুই যুগের সন্ধি ভেঙে আলাদা চিন্তা-ভাবনা করছে জামায়াত। জামায়াত আমীরের একটি বক্তব্য প্রচারের পর দল দুটির আলাদা অবস্থানের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে। অনেকে এটিকে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি বলে প্রচার করেন। সম্প্রতি এই দূরত্ব আরও বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দল দুটির নেতাদের বক্তব্যেই তা অনেকটা স্পষ্ট হচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে জোটগত ঐক্য না থাকলেও আগামী নির্বাচনের আগে যুগপৎ আন্দোলন করবে উভয় দল।
সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং এর আগে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে দু’দলের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে। সরকারবিরোধী সম্ভাব্য বড় আন্দোলনের আগে দীর্ঘদিনের মিত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে দু’দলের অভ্যন্তরেই মতবিরোধ বাড়ছে।
গত সোমবার রাজধানীর একটি সমাবেশে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘জামায়াতও উর্দু শব্দ, আওয়ামী লীগও উর্দু। দুটি একসঙ্গে মিলবে ভালো। আওয়ামী লীগ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করেনি। তাহলে কি তলে তলে তাদের পরকীয়া প্রেম চলছে? এর অর্থ, আওয়ামী লীগ গোপনে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। সেজন্য নিবন্ধন বাতিল করে না। তাই আজকে থেকে আওয়ামী-জামায়াত হবে,বিএনপি-জামায়াত আর হবে না।’
টুকুর ওই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে জামায়াত। টুকুর বক্তব্যকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে দলটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘অসংলগ্ন’ বক্তব্য থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয় দলটির পক্ষ থেকে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনের পর দলটির কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে এ রকম বিবৃতির ঘটনা এটাই প্রথম। তবে টুকুর বক্তব্য এবং জামায়াতের বিবৃতির বিষয়ে বিএনপি নীরব। এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা মুখ খুলছেন না।
বিএনপি সমর্থিত প্রভাবশালী পেশাজীবী নেতা ও বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও টুকুর কঠোর সমালোচনা করেছেন। লন্ডন থেকে অনলাইনে প্রকাশিত ওই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তিনি টুকুকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন। তার ওই সমালোচনাকে ভালোভাবে নেননি বিএনপির হাইকমান্ড। অনেক নেতা তাঁকে জামায়াতপন্থি হিসেবে মনে করছেন।
তবে বিএনপির অভ্যন্তরেও টুকুবিরোধী নেতাদের একটি অংশ এই ইস্যুতে অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যে সরব হয়ে উঠছেন। তবে জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিএনপি নেতারা টুকুর বক্তব্যকে সময়োপযোগী বলে সাধুবাদ দিচ্ছেন। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক দলকে নিয়ে পথচলার বিরোধিতা করছেন তারা।
আওয়ামী লীগ গোপনে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। সেজন্য নিবন্ধন বাতিল করে না। তাই আজকে থেকে আওয়ামী-জামায়াত হবে,বিএনপি-জামায়াত আর হবে না।
বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৯৯৭-৯৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে মধুর। জামায়াতকে রাজনীতিতে শক্ত জায়গা করে দেয়ার জন্য বিএনপিকে কম কথা শুনতে হয়নি। বিশেষ করে ২০০১ সালে জামায়াতের দুই নেতাকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়ায় বিএনপিকে এখনও অনেকে সহ্য করতে পারছে না।
জামায়াতও বিএনপির সেই আস্থার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করেছে প্রতি পদে পদে। বিশেষ করে ২০০৫ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে থেকে বিএনপিকে সর্বোচ্চ সহায়তা করে জামায়াত।
শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়টাতে একতরফা ভোট ঠেকাতে জামায়াত ছিল বিএনপির রাজপথের সঙ্গী। সারা দেশে আন্দোলন সংগঠিত করতে কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেছে ধর্মভিত্তিক এ দলটিই।
দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। যখন আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক দণ্ড- এমনকি ফাঁসি দিতে থাকে, তখন বিএনপিকে পাশে পায়নি জামায়াত। এমনকি জামায়াতের ওই সব নেতার পক্ষে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি জোটসঙ্গী বিএনপি। এতে হতাশ ও চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে জামায়াত।
এর পর থেকে বিএনপি সরকারবিরোধী যত আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দিয়েছে, সেগুলোতে জামায়াত নৈতিক সমর্থন দিয়েই দায় এড়িয়েছে। কৌশলগত কারণে জোট থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে আগের সেই সখ্য আর দেখা যায়নি। এমনকি ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাকেও দেখা যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে কোন কর্মসূচী পালন না করার কৌশল নেয় বিএনপি। কিন্তু বিএনপির চরম দুর্দিনের জোটসঙ্গী জামায়াত বিএনপির এই অবস্থানকে ভালভাবে নিচ্ছে না। ইদানীং মাঝেমধ্যেই বিএনপি ও জামায়াত নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। বিএনপির একটি অংশ চাচ্ছে দূরত্ব বজায় রেখে হলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচী যাতে জামায়াতও নিজ অবস্থানে থেকে পালন করতে পারে সেরকম একটি সুযোগ রাখতে। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে একমত হওয়া কিছু বাম দল তা চাচ্ছে না।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী জোরদার করার চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ২ মাসের লাগাতার সমাবেশ কর্মসূচী শেষ করে আবারও দুই মাসব্যাপী গণসমাবেশ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। অতীতে এ ধরনের আন্দোলনে বিএনপি তাদের শরিক দল জামায়াতকে সম্পৃক্ত করলেও এবার তা করেনি। এ ছাড়া সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে প্রায় দুইডজন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপি সংলাপ করলেও জামায়াতের সঙ্গে করেনি। আর এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেও দুই দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। ফলস্বরূপ উভয় দলের নেতারা এখন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
সম্প্রতি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দলের ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি জোটের সঙ্গে তারা আর নেই। জোটে না থাকার জন্য তিনি বিএনপিকেই দায়ী করেন। এক পর্যায়ে তার এই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এ বিষয়ে জামায়াতের অন্য নেতারা বলেন, ডাঃ শফিকুর রহমান প্রকাশ্যে এ ধরনের কথা বলেননি, তিনি নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন।
তাই জামায়াতের ২০ দলীয় জোট ছাড়ার কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বা আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। আর এ বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, জামায়ত ২০ দলীয় জোটে ছিল, এখনও আছে। ভবিষ্যতে জামায়াত কি করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত তারা নেবে। আর আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নেব।
এদিকে জামায়াতও এত প্রশ্ন কিংবা বঞ্চনা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে থাকবে কেন, তা নিয়ে ভাবছে। দলটির প্রবীণ নেতাদের একটি বড় অংশের যুক্তি হচ্ছে- শুধু বিএনপিকে রাজপথে ও ভোটের মাঠে শক্তি জোগানোর কারণে তাদের (জামায়াত) এই রাজনীতির পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। একে একে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও জামায়াত নিয়ে বিএনপি অস্বস্তিতে ভুগলে তাদের সঙ্গে থাকার দরকার কি?
এসব ভাবনা-চিন্তার দোলাচলে সম্প্রতি বিএনপির ডাকে সাড়া দেয়নি জামায়াত। নির্বাচনের পর গত বৃহস্পতিবার ধানের শীষের সব প্রার্থীকে ঢাকায় ডাকে বিএনপি। সেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের অন্য শরিকদের প্রার্থী ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও জামায়াতের কেউ ছিল না। এটিকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতির বিচ্ছেদ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৯
আপনার মতামত জানানঃ