পুরান ঢাকার জগন্নাথ সাহা রোডে ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল খুন হন সীমা মোহাম্মদী (২০)। বাড়িতে ঢুকে ছুরিকাঘাত করে সীমাকে হত্যা করে মোহাম্মদ আহমদ ওরফে আমিন নামে এক যুবক। ঘটনার পরপরই ওই যুবকের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন সীমার মা ইজহার মোহাম্মদী। দুই মাস পর ২৫ জুন পলাতক আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তদন্তে উঠে আসে সীমাকে বিয়ে করতে না পেরে সে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আদালত থেকে আসামিকে হাজিরের জন্য ১৯৯৯ সালের ২২ জুন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের পরও সাক্ষ্য দিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের অনীহার কারণে মামলার বিচারকাজ বারবার পিছিয়ে যায়। অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক আনোয়ার হোসেন সাক্ষ্য দিতে অদ্যাবধি আদালতে হাজির হননি। ওই চিকিৎসককে এ পর্যন্ত অর্ধশত অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক চমন বেগম চৌধুরীর আদালতে বিচারাধীন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত মামলার তারিখ পড়েছে ১১২ বার। ১১ জন বিচারক বদল হয়েছেন। সরকার পাল্টেছে ১০ বার। মামলার একমাত্র আসামি আমিন এখনও পলাতক। এদিকে মামলার বাদী সীমার মা বিচারের অপেক্ষায় থেকে শেষ পর্যন্ত মারা গেছেন। বাবারও মৃত্যু হয়েছে। সীমার পরিবারের সদস্য ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আসামি ধরতে পুলিশ প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। একই সঙ্গে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেয়ার অনীহায় বিচারকাজ আরও বিলম্বিত হচ্ছে। একের পর এক সমন জারির পরও বিচারিক আদালতে তাকে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। সাক্ষীকে হাজির করতে বিচারক বেশ কয়েকটি আদেশও দিয়েছেন। সোমবার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মো. আনোয়ার হোসেনের সাক্ষ্য দেয়ার তারিখ ছিল। কিন্তু এদিনও হাজির না হওয়ায় আদালত ফের সমন জারি করেছেন। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ নভেম্বর। একটি সূত্র জানায়, অনেক আগেই ডা. মো. আনোয়ার হোসেন অবসরে গেছেন। তবে বর্তমানে একটি বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চাকরি করছেন। ওই ঠিকানায় আদালতের সমন পৌঁছে কি না, তা-ও কেউ বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিশেষ পিপি আনোয়ার সাদাত শাওন যুগান্তরকে বলেন, এ মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচজনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। মামলার বাদীর প্রতিও শতবার ওয়ারেন্ট দেয়া হয়েছে। পরে আমরা জানতে পরেছি তিনি মারা গেছেন। বাদীপক্ষের কোনো আইনজীবী ও তদবিরকারী নেই। আমরা ওয়ারেন্ট দিয়েও সাক্ষী আনতে পারিনি, সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ডকুমেন্টারি সাক্ষী হলেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। ফৌজদারি কার্যবিধির ৭২ ধারায় তাকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। তিনি যেখানেই থাকুন আদালতে আনা প্রয়োজন। শাওন বলেন, বর্তমানে বাদীর পক্ষে কেউ না থাকায় রাষ্ট্র বাদী হয়েছে। এ মামলায় আসামির পক্ষে সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পাঁচজন সাক্ষীকে ওই আইনজীবী জেরা করেছেন। আমরা চাচ্ছি মামলাটি দ্রুত যেন শেষ হয়। আসামি জামিনে যাওয়ার পর আর আসেনি। সে এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে। আশা করছি চিকিৎসক সাক্ষ্য দিলেই মামলাটি শেষ হবে। মামলার বিষয়ে সোমবার কথা হয় সীমার ছোট ভাই মবিনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। তখন ছোট ছিলাম, তেমন কিছু মনে নেই। এরপরও আমি ২০০৮ সালে সাক্ষ্য দিয়েছি। মামলার খবর কী, তা-ও জানি না। আমার বোনকে যে হত্যা করেছে, তার যেন বিচার হয়। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বড় বাধা উল্লেখ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ৩২ বছরেও বিচারটি শেষ না হওয়ার ঘটনাটি সত্যি দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সাক্ষীকে যেভাবে হোক হাজির করা একান্ত প্রয়োজন।মামলার চার্জশিট থেকে জানা যায়, আসামি আমিন একজন আটকে পড়া পাকিস্তানি। তার বাবার নাম মো. জামিল। বাংলাদেশে তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। ঘটনার ২ মাস আগে তিনি তেজগাঁওয়ের উর্দু রোডের আল আমিন বোর্ডিংয়ের ৫৫ নম্বর রুমে দৈনিক ২৮ টাকা ভাড়ায় থাকতেন। সীমাকে খুন করার পর ওই বোর্ডিংয়ে আর যাননি আমিন। এরপর থেকে আর তার কোনো হদিস পায়নি পুলিশ। জানা গেছে, পলাতক আমিন গত বছর উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের জন্য আবেদন করে। পরে আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
আপনার মতামত জানানঃ