সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে একের পর এক হামলা ও খুনের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাতে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের পাহারা দেওয়ার যে পদ্ধতি চালু আছে, তা অকার্যকর করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিদ্রোহী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলো। এর ফলে ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করছে স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গারা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গত পাঁচ দিনে শিবিরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবকসহ তিন জন নিহত হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ভোরে আরও এক রোহিঙ্গাকে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অক্টোবর থেকে চালু হয় ক্যাম্পগুলোতে ব্লকভিত্তিক স্বেচ্ছা পাহারা পদ্ধতি। ক্যাম্পে নিয়োজিত উখিয়া-টেকনাফে ৮-এপিবিএন-এর আওতাধীন ক্যাম্পগুলোতে প্রতি রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এছাড়া ১৪-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার ৫১৬ জন এবং ১৬-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার সাতশ’ স্বেচ্ছাসেবক একই কাজ করছে।
এদিকে এই কার্যক্রম শুরু হওয়ায় স্বেচ্ছা পাহারার সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের বেশ কয়েকজন এসব সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ও আহত হয়েছে। গত জুলাই থেকে প্রায় তিন মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে তিন মাঝিসহ খুন হয়েছে অন্তত ১২ জন। এদের মধ্য পাঁচ জন ছিল স্বেচ্ছাসেবক।
সর্বশেষ আজ (২২ সেপ্টেম্বর) ভোরে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে দুর্বৃত্তরা মো. এরশাদ নামে এক রোহিঙ্গাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে জানান ১৪-এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আনোয়ার। এ নিয়ে পর পর দুদিনে দুই রোহিঙ্গা খুন হলো।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রাতের পাহারায় নিয়োজিত থাকা মো. জাফর (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ১৮ সেপ্টেম্বর টেকনাফ মৌচনী ক্যাম্পে ইলিয়াছ নামে এক রোহিঙ্গাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় ক্যাম্পের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে।
আমাদের ধারণা এই হামলার সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা জড়িত। ক্যাম্পে এসব ঘটনার পর থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা ভয়ে আছে।’
ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবীদের হত্যার ঘটনায় জাফরের সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবক রোহিঙ্গা নেতা মো. হারুন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা এই হামলার সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা জড়িত। ক্যাম্পে এসব ঘটনার পর থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা ভয়ে আছে।’
তিনি জানান, তার ক্যাম্পে প্রায় ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে, যাদের তৎপরতায় ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসীরা বাধার মুখে পড়ছে। ফলে সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এর আগে গত জুন মাসে তার ক্যাম্পের একজন স্বেচ্ছাসেবক মাঝিকে (নেতা) গুলি চালিয়ে হত্যা করে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে ১৪ এপিবিএন-এর সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন) মো. ফারুক আহমেদ জানান, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীদের পাহারার ফলে ক্যাম্পে আগের তুলনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে এসব গ্রুপ এখন নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করছে। শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসী দল নিরাপত্তাকর্মীদের টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে। এরা প্রতিনিয়ত অবস্থান ও কৌশল বদল করে কার্যক্রম চালায়। কিন্তু তাদের টার্গেট কোনোভাবে সফল হবে না। আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫-২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। এখানে প্রতিদিন প্রায় শত কোটি টাকার ইয়াবা-আইস ও সোনা চোরাচালানের লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই হয়।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে তৈরি করেছে অপরাধী গ্রুপ। তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এতে প্রায়ই খুন, সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটছে অপহরণের মতো ঘটনাও। এ ছাড়া ধর্ষণ, ডাকাতির ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবার আখড়ায় পরিণত করেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টেও পরিণত হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ