গোটা দেশেই চিকিৎসাক্ষেত্র শাসন করছে একটি চক্র। প্রথম সারিতে চিকিৎসক, ২য় সারিতে ক্লিনিক ও হাসপাতাল মালিক আর পিছনে গ্রাম্য ডাক্তার, দালাল এবং বিভিন্ন শ্রেণির আরো কয়েকজন মানুষ মিলে গড়ে তুলেছে চিকিৎসায় কমিশন গ্রহনের এক শক্ত সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে একজন রোগীর পক্ষে কম খরচে ও নির্ভেজাল চিকিৎসা নেওয়া অসম্ভব।
মনে করেন আপনার ফার্মাসিস্ট-কাম-গ্রামের ডাক্তার আপনার উন্নত চিকিৎসার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ বা হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার রেফার করলো। আপনি হয়তো মনে করবেন, আপনার স্বাস্থ্যের জন্য তা প্রয়োজনীয় এবং এতে আপনার সর্বোত্তম স্বার্থ জড়িত।
কিন্তু বাস্তবে আপনার ‘ডাক্তার’ আপনাকে অন্য ডাক্তার বা চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার করার অন্য একটি নিহিত স্বার্থ থাকতে পারে। হতেই পারে যে, এই রেফার করার মাধ্যমে তিনি কমিশন হিসেবে আপনার স্বাস্থ্যগত ব্যয়ের একটি অংশ উপার্জন করছেন।
গ্রামের মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের শতকরা ৫০ ভাগ অর্থই এখন খরচ হচ্ছে গ্রাম্য ডাক্তারদের কমিশন পরিশোধে। অধিকাংশ রোগী জানে না এমন কমিশনের কথা। গ্রাম ও শহরের ফার্মেসির বেশিরভাগ দোকানদার বা গ্রাম্য ডাক্তার কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, হাসপাতালের দালাল, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, সিএনজি চালক এমনকি একই পরিবারের লোকেরাও রোগী থেকে নিচ্ছে কমিশন। পরিস্থিতি বুঝে রোগের পরীক্ষা থেকে শুরু করে অপারেশন- সব ক্ষেত্রেই ২০ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন দিতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের এজেন্টদের।
লক্ষ্মীপুর জেলার বেসরকারি হাসপাতালের কয়েকজন মালিক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি চালক, কয়েকজন ভুক্তভোগী রোগী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং জেলা সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ত্রিভুজ চিত্রের মতো প্রথম সারিতে চিকিৎসক, ২য় সারিতে ক্লিনিক ও হাসপাতাল মালিক আর পিছনে গ্রাম্য ডাক্তার, দালাল এবং বিভিন্ন শ্রেণির আরো কয়েকজন মানুষ মিলে গড়ে তুলেছে চিকিৎসায় কমিশন গ্রহনের এক শক্ত সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে একজন রোগীর পক্ষে কম খরচে ও নির্ভেজাল চিকিৎসা নেওয়া অসম্ভব।
এসময় তারা জানায় কমিশনের কারণে খরচ ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় অপারেশন করা হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় বহু পরীক্ষা করতে হয় এবং চিকিৎসায় সময় বেশি লাগে।
তাছাড়া, কমিশনের কারণে স্থানীয় মেডিকেলে যে পরীক্ষাগুলো করা হয় সেগুলোর মান যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ডাক্তার পরিবর্তনের সাথে সাথে একই পরীক্ষা বারবার করতে হয়। এ অবস্থাকে জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলতা হিসেবে মনে করছে স্থানীয় মানুষ।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ফার্মেসি ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন (২৫)। তিনি জানান, গ্রামের সাধারণ মানুষ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে সহায়তার জন্য আসে নিজ এলাকার পরিচিত ফার্মেসির গ্রাম্য ডাক্তারের নিকট। কিন্ত সেই ফার্মেসি ব্যবসায়ী সুযোগ ও আর্থিক অবস্থা বুঝে রোগীকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠিয়ে গোপনে নেয় চুক্তি ভিত্তিক কমিশন।
তিনি জানান, আমার আশপাশের সকল গ্রাম্য ডাক্তার এখন এমন ব্যবসা সাথে জড়িত। বর্তমানে ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের রেফারেন্সে যত রোগী কোন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেয়, সে রোগীর মোট খরচের ৫০ ভাগ টাকাই পায় ওই ফার্মেসি ব্যবসায়ী। এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কি হতে পারে?
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় শিপন কুরীর (ছদ্মনাম) কথা। তার ৫ বছরের ছেলের শরীরে এলার্জির মতো কিছু একটা দেখা গেলে তিনি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর বাজারের একটি ঔষধের দোকানে নিয়ে আসেন তাকে।
ফার্মেসী মালিক তার ছেলেকে লক্ষ্মীপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালী জেলার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠায়। সে হাসপাতালের একজন চিকিৎসক তাকে ১১টি পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়। এতে তার খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা।
শিপন কুরী পুরো দিন নোয়াখালী অবস্থান করে ছেলের সব পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে রাতে বাড়িতে ফিরেন। চিকিৎসক সব পরীক্ষা শেষে তাকে শুধুমাত্র এলার্জির ২টি ঔষধ লিখে দেন। তিনি বাড়ি ফিরে অন্য একজনের মাধ্যমে জানতে পারেন ফার্মেসির মালিক তার পরীক্ষার অর্ধেক কমিশন পেয়েছেন এবং ৭টির মতো পরীক্ষা বিনা কারণে করা হয়েছে।
বশিকপুর বাজারের ১০টি ফার্মেসী ব্যবসায়ীর ৩ জন ব্যবসায়ী কমিশন ব্যবসায় জড়িত হয়ে এখন কোটিপতি হয়েছেন বলে জানান শিপন কুরী। কয়েকটি হাসপাতালেও রয়েছে তাদের শেয়ার।
লক্ষ্মীপুর শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজার দিদার জানান, তাদের হাসপাতালে সন্তান সম্ভাব্য যেসব রোগী ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের রেফারেন্সে ভর্তি হন, সে সব রোগীর মোট খরচের ৫০ ভাগ ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের কমিশন হিসেবে দিতে হয়।
তিনি আরো জানান, কোনো রোগী যখন ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের কে নিয়ে আসেন কিংবা তাদের রেফারেন্সে আসেন তখন তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খরচ কম নিতে পারেন না।
রায়পুর শহরের মাতৃছায়া হাসপাতালের মালিক আবদুর রহমান তুহিন বলেন, “এখন অ্যাম্বুলেন্স চালক, সিএনজি ড্রাইভার, মেয়ের বাবা এমনকি ভাবীকে ভর্তি করে দেবর ননদরাও কমিশন নিচ্ছেন। তিনি বলেন, সকল বেসরকারি হাসপাতাল একত্রে যদি কমিশন দেওয়া বন্ধ করে তখন রোগীরা কম টাকায় ভালো ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন, গ্রাম্য ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে চিকিৎসা ব্যয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
জেলা শহরের ৫টি বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজারদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, ফার্মেসি ব্যবসায়ী, মৌসুমী দালাল, কিছু চিকিৎসকদের চাপে অনেক সময় ক্লিনিক মালিকরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করায়।
ফাতেমা আক্তার নামে এক গৃহিনী জানায়, তার ছোট শিশুর জ্বর থাকার কারণে কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ওখানকার উপকূল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ৩টি পরীক্ষা করান। পরে ওই চিকিৎসক তার রিপোর্ট দেখে শিশুটিকে লক্ষ্মীপুর ফেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে একজন শিশু চিকিৎসকের কাছে পাঠান। কিন্তু ওই চিকিৎসক তাকে পুনরায় একই পরীক্ষাগুলো করতে দেন তার চেম্বারের সেন্টারে।
লক্ষ্মীপুর ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলাম শরীফ বলেন, “অনেক সময় আমরা দেখি কোন বেসরকারি হাসপাতালের একজন রোগীর অপারেশন বাবদ যে খরচ নেওয়া হয় তা প্রচলিত খরচের তুলনায় ৫০ ভাগ বেশি। পরে আমরা বুঝি বেশি অংশ রাখা হয় একজন কোয়াকের জন্য। আমাদের প্রশ্ন এ কেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা? যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একজন রোগীর জীবন বাঁচিয়ে যে খরচ নিয়েছেন, তার সমান খরচ নিয়েছেন একজন ব্যক্তি তাকে হাসপালে নিয়ে এসে।”
লক্ষ্মীপুরের কোন এলাকার রোগীদের কমিশন দিতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে ৪টি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মার্কেটিং বিভাগের ৫জন কর্মকর্তা জানায়, রেফারেন্সে সব চেয়ে এগিয়ে লক্ষ্মীপুরের উত্তর পূর্ব এলাকা, রামগঞ্জ ও রায়পুর উপজেলা। এসব এলাকার বেশির ভাগ পরিবারের কর্তারা প্রবাসী। আর প্রবাসীদের পরিবার পুরোপুরি ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল।
কমিশন বাণিজ্য কেন মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে- এমন বিষয় জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের লক্ষ্মীপুর জেলা সভাপতি প্রফেসর জেএম ফারুকী বলেন, “রোগীরা অজ্ঞাতভাবে যাকে তাকে বিশ্বাস করছে। বিভিন্ন কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালের প্রতি যখন বিরক্ত ঠিক সেই সময় সুযোগ নেয় প্রাইভেট হাসপাতালের এজেন্টরা। এ সুযোগে নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।”
“সেই সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে ক্রমাগত বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। তাছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরীক্ষার মান বিষয়ে কোন ধরনের মনিটরিং না থাকায় এ সমস্যা এখন ভয়ংকর হয়ে দেখা দিয়েছে।”
স্থানীয় ভাবে জানা যায়, ১টি সরকারি হাসপাতাল ও ৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রক্ত ও প্রসাবের ২-৩টি সাধারণ পরীক্ষা ছাড়া আর কোনো পরীক্ষা হয় না। কোথাও যন্ত্র আছে টেকনেশিয়ান নেই, আবার কোথাও যন্ত্রপাতি নেই।
এমন অভিযোগেই সরকারি হাসপাতালের ল্যাবলেটরিতে অনেক পরীক্ষা হয় না। স্থানীয়রা বলছে বিষয়টি পরিকল্পিত এবং সিন্ডিকেটের কাজ। এ সিন্ডিকেটের পেছনেও রয়েছে বেসরকারি ক্লিনিকের উদ্যোক্তা ও দালালদের থেকে কমিশন গ্রহণের সুযোগ।
চিকিৎসায় কমিশন বাণিজ্যকে প্রশাসন কিভাবে দেখছে, এমন প্রশ্নে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহাম্মদ কবির জানিয়েছেন, “কমিশন বাণিজ্যের পেছনে রোগীদের অসচেতনতা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তা কর্মীর অভাব রয়েছে এ সুযোগে দালালরা হাসপাতালে প্রবেশ করে সেখান থেকে সহজেই রোগী ভাগিয়ে নিতে পারছে। তাছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসক ও ল্যাবের টেকনিশিয়ানের অভাবের কারণে সবসময় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভালো সেবা দেওয়া যায় না। সেকারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নিচ্ছে।”
লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৮ লাখ ৩৯ হাজার মানুষের লক্ষ্মীপুরে জেলা সদর হাসপাতাল ১টি, ৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩ টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ২১টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ১৭৯ টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্ত একমাত্র জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়া বাকি কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভালো পরীক্ষাগার নেই। সদর হাসপাতালে অপারেশন বিভাগ চালু থাকলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। সে কারণে জেলার লোকজন চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের সরাপন্ন হয়ে কমিশনের ফাঁদে পড়ছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান চৌধুরী তুহিন জানান, জেলায় মোট প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ১৬২টি যার মধ্যে শুধু হাসপাতাল রয়েছে ৬০টি।
স্থানীয়দের অভিযোগ দেশের প্রচলিত চিকিৎসায় ব্যবস্থায় ডাক্তাররা কোন রোগীকে কী রোগের জন্য কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিচ্ছেন, এ পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি না তা দেখতে অডিট ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই। এর ফলে এক শ্রেণির চিকিৎসকের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা চিকিৎসায় গ্রাম্য ডাক্তারের মাধ্যমে কমিশন প্রথার মতো একটি বাজে প্রথা চালু করেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ