লিজ ট্রাসের স্কুলে একবার জাতীয় নির্বাচনের আদলে সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। সাত বছরের ট্রাস সেখানে মার্গারেট থ্যাচারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
যদিও ট্রাস এখনও ওই পর্যায়ে পৌঁছাননি যেখানে গেলে তাকে মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
অনেক বছর পর ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে করে ট্রাস বলেছিলেন, ‘‘আমি ওই সুযোগ লুফে নিয়েছিলাম এবং ভোটারদের উদ্দেশ করে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত একটি ভোটও পাইনি। এমনকি আমি নিজেই নিজেকে ভোট দেইনি।”
সেই সাজানো নির্বাচনের ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও যে কোনো সুযোগ লুফে নিতে দারুণ পারদর্শী ট্রাস। লৌহমানবী হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তার ‘আইডল’।
তাকে অনুসরণ করেই লিজ ট্রাস আজ কনজারভেটিভ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন এবং যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার অভিষেক হতে চলেছে।
নেতা নির্বাচনের জন্য টোরি এমপিদের প্রথম দিকের কয়েক দফা ভোটের সবগুলোতেই অবশ্য সাবেক চ্যান্সেলর ঋষি সুনাকের ঠিক পেছনে ছিলেন তিনি।
কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঋষি সুনাককে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন ট্রাস। চূড়ান্ত ভোটের ফল প্রকাশের আগে বুকমেকাররা তাকেই স্পষ্ট বিজয়ী হিসেবে দেখেছেন।
ট্রাস বছরের পর বছর ধরে আন্তরিকভাবে ইলেক্টোরাল ডিস্ট্রিক্টগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন মজবুত করেছেন।
তিনি তার পূর্বসুরি বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও তার প্রতি আস্থা রেখে গেছেন। যেখানে ওই সময় দলের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতাই জনসনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আরো নানা দিক দিয়ে লিজ ট্রাস ঠিক প্রচলিত টোরি নেতাদের মত নন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
মেরি এলিজাবেথ ট্রাস ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে ট্রাস বলেন, তিনি গণিতের অধ্যাপক।
ট্রাসের মা একজন নার্স, যিনি ‘বাম-পন্থি’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ছোট বয়সে ট্রাসের মা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রচার সংগঠনের (সিএনডি) কর্মসূচিতেও অংশ নিতেন।
ট্রাসের বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন তার পরিবার গ্লাসগোর পশ্চিমে পেইসলিতে বসবাস শুরু করে।
বিবিসি রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাসের ভাই তার সম্পর্কে বলেছিলেন, তারা পরিবারের সবাই মিলে ‘বোর্ড গেম’ খেলতে ভালোবাসতেন। কিন্তু ট্রাস হারতে ঘৃণা করতেন। হেরে যেতে পারেন এই ভয়ে তিনি মাঝে মধ্যেই যাতে খেলতেই না হয় সেজন্য খেলার সময় উধাও হয়ে যেতেন।
তারপর পরিবারটি লিডস এ চলে যায়। সেখানেই একটি সেকেন্ডারি স্কুলে লেখাপড়া শুরু হয় ট্রাসের। সেখানে তিনি ‘ওইসব ব্যর্থ শিশুদের মত ছিলেন, যাদের নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা করা হত না’।
স্কুল শেষে ট্রাস অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পান। সেখানে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং প্রথমে লিবারেল ডেমোক্রেটদের হয়ে কাজ করতেন।
১৯৯৪ সালে দলটির হয়ে একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ট্রাস। বলেছিলেন, ‘‘আমরা লিবারেল ডেমোক্রেটরা সবার জন্য সুযোগে বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বাস করি না মানুষ শাসন করার জন্য জন্মেছে।”
রাজনীতির শুরু
অক্সফোর্ডে পড়ার সময়ই দল বদল করে কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন ট্রাস। গ্রাজুয়েশন শেষে তিনি হিসাবরক্ষক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন। ২০০০ সালে তিনি সহকর্মী হিসাবরক্ষক হিউ ও’লেরি কে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুইটি সন্তান রয়েছে।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ট্রাস ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের হেমসওর্থ আসনে টোরি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, কিন্তু হেরে যান।
২০০৫ সালে তিনি ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ক্যালডার ভ্যালি আসন থেকেও হেরে যান। কিন্তু পরপর দুইবার হেরে গেলেও তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অপ্রতিরোধ্য ছিল।
২০০৬ সালে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের গ্রিনউইচ থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ২০০৮ সালে তিনি ‘রাইট-অব-সেন্টার রিফর্ম থিঙ্ক ট্যাঙ্কে’ কাজ করেন।
কনজারভেটিভ দলের সাবেক প্রধান ডেভিড ক্যামেরনের ট্রাসের উপর প্রচণ্ড আস্থা ছিল। তিনিই ট্রাসকে ২০১০ সালের নির্বাচনে অগ্রাধিকার পাওয়া প্রার্থীদের তালিকা ‘এ-লিস্টে’ জায়গা দেন।
সেবারের নির্বাচনে তিনি কনজারভেটিভদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আসন সাউথ ওয়েস্ট নরফোক আসন থেকে প্রার্থী হন এবং বিজয় লাভ করেন।
কিন্তু তারপরই প্রকাশ পায় কয়েক বছর আগে তিনি টোরি এমপি মার্ক ফিল্ডের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। যে কারণে ‘কন্সটিটুয়েন্সি টোরি অ্যাসোসিয়েশন’ তার প্রার্থিতা বাতিল করে। যার বিরুদ্ধে তাকে লড়াইয়ে নামতে হয়। কিন্তু সেবার তাকে উৎখাতের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি আগেরবারের চেয়ে ১৩ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জেতেন।
এমপি হওয়ার মাত্র দুই বছর পর ২০১২ সালে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে সরাসরি সরকার পরিচালনায় চলে আসেন। ২০১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি পরিবেশমন্ত্রী হন।
ব্রেক্সিট ইউ-টার্ন
২০১৬ সাল যুক্তরাজ্যের রাজনীতির জন্য ঐতিহাসিক একটি বছর। সে বছরই যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা বা না থাকা নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যা ব্রেক্সিট নামে পরিচিত। ট্রাস বেক্সিটের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি ইইউ-র সঙ্গে থেকে যাওয়ার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন।
ওই সময় ‘দ্য সান’ পত্রিকায় একটি কলামে তিনি লিখেছিলেন, ব্রেক্সিট হলে ‘তিনটি হৃদয়বিদারক ঘটনা একসঙ্গে ঘটবে। ইইউতে পণ্য বিক্রি করতে গেলে আরও নিয়ম, আরো ফর্ম এবং আরও দেরি হবে’।
গণভোটে তার পক্ষ হেরে যায় এবং ট্রাসও পক্ষ পরিবর্তন করে ব্রেক্সিটের পক্ষে চলে আসেন। বলেন, ‘‘ব্রেক্সিট প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মের মন্ত্রিসভায় তিনি বিচারমন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি ট্রেজারি মন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ট্রাস আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমন্ত্রী হন।
২০২১ সালে ৪৬ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের সবথেকে শীর্ষ পদগুলোর একটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ডমিনিক রাবের কাছ থেকে তিনি দায়িত্ব পান।
ইরানি বংশোদ্ভূত দুই ব্রিটিশ নাগরিক ইরানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যাদের মুক্তি নিশ্চিত করে প্রশংসিত হয়েছিলেন ট্রাস।
গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করলে প্রথম থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন ট্রাস। ট্রাসের মন্তব্যের কারণেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
যুক্তরাজ্য থেকে যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইউক্রেইন যেতে চেয়েছিলেন ট্রাস তাদের সমর্থন করেন। যে কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন।
প্রতিশ্রুতি দিলেও বিস্তারিত জানাচ্ছেন না
প্রধানমন্ত্রী হলে কী কী করবেন তা নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও কিভাবে ওইসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন সে বিষয়ে ট্রাস বিস্তারিত কিছু বলছেন না। যে কারণে সামালোচিত হচ্ছেন তিনি।
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কীভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বর্তমান সংকট মোকাবেলা করবেন। জবাবে তিনি বলেন, তিনি জনগণের উপর থেকে করের বোঝা কমানোর দিকে অধিক মনযোগ দেবেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাননি তিনি।
স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টুর্জেনকে তিনি ‘মনোযোগ আকর্ষণকারী’ হিসেবে বিদ্রুপ করে বলেছেন, সবচেয়ে ভালো হল ‘তাকে উপেক্ষা করা’। এসব মন্তব্যের কারণে ট্রাস যতই সমালোচিত হন না কেন। জনমত জরিপগুলোতে তিনি ঋষি সুনাকের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন।
ট্রাস পোশাক-পরিচ্ছদে মার্গারেট থ্যাচারকে অনুকরণের চেষ্টা করেন বলেও মনে করেন অনেকে। যদিও ট্রাস তা স্বীকার করেননি।
বরং তিনি জিবি নিউজকে বলেছেন, ‘‘এটা খুবই হতাশাজনক যে নারী রাজনীতিবিদদের সবসময় মার্গারেট থ্যাচারের সাথে তুলনা করা হয়। যেখানে পুরুষ রাজনীতিবিদদের সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেড হিথের সাথে কখনও তুলনা করা হয় না।”
তবে ট্রাস যাই বলেন না কেন, থ্যাচারের সঙ্গে তার তুলনা কিন্তু সব সময় খারাপ না। বরং মাঝেমধ্যে তার পক্ষেও কাজ করে। বিশেষ করে যখন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের কথা আসে।
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার কনজারভেটিভ দল ও সমর্থকদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়াও ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
থ্যাচারই যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী এবং সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী। ট্রাস কতটা থ্যাচার হয়ে উঠতে পারবেন সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ