যেকোনো প্রাণীর জন্মের জন্য প্রয়োজন হয় শুক্রাণু এবং নিষিক্ত ডিম্বাণু। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভ্রুণ উৎপন্ন করতে চাইলেও শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু ছাড়া তা সম্ভব নয়। তবে একদল বিজ্ঞানী প্রকৃতির চিরসত্য এই নিয়মকে মিথ্যা প্রমাণিত করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ছাড়াই ভ্রুণ তৈরি করে দেখিয়েছেন। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও রাসায়নিক উপায়ে প্রাণীর ভ্রুণ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ভ্রূণ (সিনথেটিক এমব্রায়ো) তৈরি করেছেন, যাতে মস্তিষ্ক, স্পন্দনক্ষম হৃদ্যন্ত্রসহ শরীরের অন্য অঙ্গ তৈরির উপাদান বিদ্যমান রয়েছে।
এই ভ্রূণ তৈরি করা হয়েছে ইঁদুরের স্টেম সেল থেকে। শরীরের একটি আদি কোষ হলো স্টেম সেল। সাধারণত জন্মের পর একটি কোষ থেকে সব ধরনের কোষ তৈরি হয়।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ডিম্বাণু অথবা শুক্রাণু ব্যবহার করার বদলে কেমব্রিজের অধ্যাপক ম্যাগডালেনা জের্নিকা-গোয়েৎজের নেতৃত্বাধীন বিজ্ঞানীদের একটি দল স্টেম সেল ব্যবহার করে কৃত্রিম ভ্রূণের মডেলটি তৈরি করেছেন।
এটি শরীরের স্টেম সেল এবং প্রায় যেকোনো ধরনের কোষের পার্থক্য করতে পারে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি, ডেভেলপমেন্ট ও নিউরোসায়েন্স বিভাগের ম্যামালিয়ান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড স্টেম সেল বায়োলজির অধ্যাপক ম্যাগডালেনা জের্নিকা-গোয়েৎজ।
গবেষকেরা বলেন, আদিম স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে উপস্থিত তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন স্টেম সেলকে এমন এক পর্যায়ে আনা হয়েছিল, যেগুলো গবেষণাগারে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় অনুকরণ করে মিথস্ক্রিয়া শুরু করে।
গবেষকেরা একটি নির্দিষ্ট ধরনের জিনের উৎপাদন উসকে দেন এবং সেসবের মিথস্ক্রিয়ার জন্য বিশেষ পরিবেশ তৈরি করেন। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা স্টেম সেলগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে ‘মিথস্ক্রিয়া’ ঘটাতে সক্ষম হন।
গবেষক ম্যাগডালেনার বরাত দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের ইঁদুরের ভ্রূণের মডেল শুধু মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়নি, বরং একটি স্পন্দনক্ষম হৃৎপিণ্ডও তৈরি করেছে। এতে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা শরীরের গঠনে ভূমিকা রাখে।’
ম্যাগডালেনা আরও বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য যে আমরা এতটা পেয়েছি। বছরের পর বছর ধরে আমাদের সম্প্রদায়ের স্বপ্ন ছিল এটি। এক দশক ধরে আমাদের কাজের প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরির বিষয়টি। অবশেষে আমরা সফল হয়েছি।’
গর্ভধারণের সময় কেন কিছু সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয় থাকে, তা বুঝতে গবেষক ম্যাগডালেনা ও কেমব্রিজের গবেষক দল গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায় নিয়ে এক দশক ধরে গবেষণা করছেন।
ম্যাগডালেনা বলেন, ‘স্টেম সেল ভ্রূণের মডেলটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের এমন একটি পর্যায় সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে, যা সাধারণত মাতৃগর্ভে ক্ষুদ্র ভ্রূণ হিসেবে আড়ালেই থেকে যায়।’
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, ভ্রূণের বিকাশকে নির্দেশ করতে বাইরের কোষগুলো কেবল রাসায়নিকভাবে নয়, যান্ত্রিকভাবেও বা কেবল স্পর্শগতভাবেও ভ্রূণ কোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে।
এদিকে, চলতি মাসের শুরুতে এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও রাসায়নিক উপায়ে প্রাণীর ভ্রুণ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন ইসরায়েলের বিজ্ঞানীরা, যা ছিল ইতিহাসে প্রথম।
বিজ্ঞান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘সেল’ এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ইসরায়েলের উইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের একদল বিজ্ঞানীর এই অসামান্য সাফল্যে এনে দিয়েছেন বিজ্ঞানকে। ‘অ্যাসিসটেড রিপ্রোডাকশন টেকনোলজি’ পদ্ধতিতে একটি ইঁদুরের ভ্রুণ সফলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভ্রুণ সৃষ্টি করা মানেই একটি প্রাণীকে সৃষ্টি করা গেছে তা বলা যায় না। কারণ ভ্রুণ থেকে একটি পরিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে জন্ম দিতে অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবু মানব ইতিহাসে মানুষের হাত দিয়ে একটি পরিপূর্ণ ভ্রুণ সৃষ্টির এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও ইঁদুরের ভ্রুণ তৈরি করা গেলেও এই উপায়ে মানুষের ভ্রুণ সৃষ্টি করার বিষয়ে এখনই কোনো পরিকল্পনা নেই বিজ্ঞানীদের। তারা বলছেন, প্রথমত ডিম্বাণু-শুক্রাণু ছাড়া মানুষের ভ্রুণ তৈরি করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল।
তাছাড়া, সৃষ্টির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ মানুষকে সৃষ্টি করার বিষয়টি ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই এখনই এ বিষয়টি নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনা নেই তাদের। তবে বিতর্ক থাকলেও বিজ্ঞানের অগ্রগতির হিসেবে এই আবিষ্কার ভবিষ্যৎকে পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ