মাদ্রাসায় জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের বেসরকারি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের সরকার।
ভারতের আসামে মাদ্রাসা ও মসজিদে বহিরাগত শিক্ষক ও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের পুলিশি যাচাই-বাছাইসহ রাজ্য সরকারের তথ্যপুঞ্জিতে নিবন্ধিত হতে হবে, নতুন এই নীতিমালা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা।
গত শনিবার গোয়ালপাড়া জেলার দুটি মসজিদ থেকে দুজন ইমাম এবং গত চার মাসে অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশের নাগরিকও আছেন। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সঙ্গে তাদের অনেকের যোগাযোগ রয়েছে বলেও মনে করছে পুলিশ। ভারতে এই ধরনের মামলায় বেশ কয়েক বছর জেলে থাকার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেকসুর খালাস পান অভিযুক্ত ব্যক্তিরা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীর হোতা আসামের একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। জঙ্গি তৎপরতা আশপাশের অনেক গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। জিহাদি কর্মকাণ্ড ও নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটাতে এমন ৬ ব্যক্তি বাংলাদেশ থেকে আসামে প্রবেশ করেন। রাজ্যের পুলিশ তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য পাঁচজন পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
গতকাল সোমবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন, বাইরের রাজ্য থেকে আসা কোনো ব্যক্তি আসামের মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষক হতে চাইলে তাদের কাগজপত্র এবং অতীত কাজকর্ম খতিয়ে দেখবে পুলিশ। এরপর তাদের অনলাইন নথিভুক্তিকরণ হবে। এ জন্য আসাম সরকার একটি পোর্টাল খুলবে, যেখানে অন্য রাজ্যের ইমাম বা শিক্ষকদের নাম–ঠিকানা নথিভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন কিছু মানসম্পন্ন নীতিমালা (স্ট্যাডার্ট অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপি) মেনে চলব। আসামের কোনো গ্রামের মসজিদে কোনো বহিরাগত যদি ইমাম হতে চান, তবে এলাকাবাসীকে তার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হবে। পুলিশি যাচাই-বাছাই (পুলিশ ভেরিফিকেশন) শেষে তাকে ইমাম নিযুক্ত করা যাবে। ‘আসাম মুসলিম সোসাইটি’ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমাদের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই নীতিমালা আসামের বাসিন্দাদের ওপর প্রযোজ্য হবে না। যারা আসামের বাসিন্দা তাদের এমন নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে না। তবে যারা রাজ্যের বাইরে থেকে এসেছেন তাদের অবশ্যই বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্যরাজ্যের তথ্যপুঞ্জিতে যুক্ত করতে হবে।
চলতি বছরের মার্চ থেকে রাজ্য পুলিশ জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সন্দেহে ৪০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। এর পরই সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতা শুরু হয় রাজ্যের পক্ষ থেকে।
এর আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, ভারতের এই রাজ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া জিহাদিদের সঙ্গে বাংলাদেশভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আনসারুল ইসলামের যোগসাজশ রয়েছে।
৪ আগস্ট গুয়াহাটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আনসারুল ইসলামের ছয় বাংলাদেশি সদস্য সম্প্রতি আসামে এসে এখানকার যুবকদের প্ররোচিত ও পথভ্রষ্ট করতে শুরু করেন। তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই বছরের মার্চ মাসে বারপেটা অঞ্চলে মৌলবাদী জঙ্গিদের একটি ধরন প্রথম কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় ওই ব্যক্তিকে।’
আনসারুল ইসলামের ছয় বাংলাদেশি সদস্য সম্প্রতি আসামে এসে এখানকার যুবকদের প্ররোচিত ও পথভ্রষ্ট করতে শুরু করেন। তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আসামের বাইরের ইমামদের মাধ্যমে এখানকার বেসরকারি মাদ্রাসায় মুসলিম যুবকদের প্ররোচিত করা খুবই উদ্বেগজনক,’ তিনি যোগ করেন।
‘সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ থেকে খুব ভিন্ন এমন সব জিহাদি কার্যকলাপ। এটি বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপকভাবে শুরু হয়। দীক্ষা নিয়ে প্রথম দিকে ইসলামি মৌলবাদের প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তারা এবং পরে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন,’ যোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে আসাম পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভাস্কর জ্যোতি মোহন্ত ও গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা হীরেন নাথ গত সোমবার বেসরকারি মাদ্রাসা বোর্ড অল আসাম তনজিম কওমি মাদ্রাসার সচিব মাওলানা আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। মোহন্ত বলেন, বৈঠকে তনজিম কওমির পক্ষ থেকে তাদের হাতে বেসরকারি মাদ্রাসার একটি তালিকা তুলে দেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে জ্যোতি মোহন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা আসামের সব মাদ্রাসার একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। এটি একটি কঠিন কাজ, কারণ এমন অনেক মাদ্রাসা আছে, যারা নথিভুক্ত নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতবিরোধী জিহাদি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তারা মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে মৌলবাদী কাজকর্ম করতে না পারে।’
২০২০ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা আইন পরিবর্তন করে রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলোকে সাধারণ স্কুলে পরিণত করে আসাম সরকার। সে সময় আসামের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এরপর ২০২১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। এর এক বছর পরেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইনের বৈধতার স্বীকৃতি দেন গুয়াহাটি হাইকোর্ট। মুসলমান সমাজের একটা অংশ ও বিরোধীরা এই আইন এবং রায়ের বিরোধিতা করলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
ফলে আসামে সরকারি মাদ্রাসা স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসামে একটি মাদ্রাসা পরিচালন বোর্ডের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিকে সরকারি মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ হলো, আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত অনুদান নিয়ে যে মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, সরকার এর তালিকা করতে শুরু করল। আমার ব্যক্তিগত মত, ভবিষ্যতে এখানেও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া বন্ধ হবে। মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ প্রবেশ করেছে, এই অভিযোগে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৩২
আপনার মতামত জানানঃ