করোনাকালে বেড়েছে নারী উন্নয়নে বড় বাধা বাল্যবিবাহ, যা নারী নেতৃত্বের পথেও অন্তরায়। করোনাকালে স্কুলগুলো বন্ধ, কাজ না থাকা, যৌন সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাল্য বিয়ে আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আলোচ্য অবস্থানে।
করোনা মহামারিতে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নানা কারণে ঝরে পড়ছে বহু শিক্ষার্থী। এদের একটি বড় অংশ শিকার হয়েছে বাল্যবিয়ের। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এক বিদ্যালয়েই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আবার একই গ্রামে একাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনাও আছে। উপকূলীয় ও হাওড়াঞ্চলে অনেক ছাত্রীর মাথায় সংসারের বোঝা চেপেছে। অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা অনেকটা গোপনেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের। এই ছাত্রীদের আর ক্লাসে ফেরার সম্ভাবনা নেই।
করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকিদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২০ হাজার ২৯৪টি।
এর আগে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ব্যানবেইসের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজার। অর্থাৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৬২ হাজার।
করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকিদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।
দেশে মাউশির নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। মাউশির প্রতিবেদন বলছে, বার্ষিক পরীক্ষায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার (৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ) বেশি, বরিশাল অঞ্চলে অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে কম (৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)।
বাল্যবিবাহের কারণে অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে (১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ), সবচেয়ে কম সিলেট অঞ্চলে (৪ দশমিক ৩০ শতাংশ)।
সম্প্রতি মাউশি সূত্রে জানা যায়, সিলেটের জৈন্তাপুরের শাড়িঘাট হাইস্কুলে ২০২০ সালে ৭৪৬ শিক্ষার্থী ছিল। ২০২১ সালে শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৬৮৪ জনে। বিদ্যালয়টির ১৪ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে।
শিশুশ্রমে যুক্ত শিক্ষার্থীও রাজশাহী অঞ্চলে বেশি। এ কারণে এই অঞ্চলে প্রায় ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। কম চট্টগ্রাম অঞ্চলে (প্রায় ১৩ শতাংশ)।
মাউশি দেশের সব বিদ্যালয়ের কাছেই তথ্য চেয়েছিল। তবে তথ্য দিয়েছে ১১ হাজার ৬৭৯টি। এগুলোয় গত বছর মোট শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ৬৬ লাখ ৫০ হাজার, যা ২০২০ সালে ছিল ৬৫ লাখ ৫৬ হাজার। এই তথ্য বলছে, বিদ্যালয়গুলোয় করোনার মধ্যেও প্রায় ৯৩ হাজার বেড়েছে শিক্ষার্থী।
করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। টানা প্রায় ১৮ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে সশরীর ক্লাস শুরু হয়। করোনার কারণে গত বছরের নভেম্বরে মাধ্যমিকে (ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি) বার্ষিক পরীক্ষা এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষা হয় মাত্র তিন বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ গণিত)।
মাউশি বলছে, গত বছর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল প্রায় ৬১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। অনুপস্থিত ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহ ও ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শিশুশ্রমে যুক্ত হওয়ায় বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।
সাধারণ নিয়ম হলো, বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই পরবর্তী ক্লাসে উঠতে পারে। ফলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বড় অংশেরই ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাল্যবিবাহ কিশোরী মেয়েদের সহজাত উচ্ছ্বাস, বৃদ্ধি ও গতিশীলতাকে থামিয়ে দেয়। প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব থাকে। এর ফলে অধিক সন্তান গ্রহণের প্রবণতা তৈরি হয়। কৈশোরকালে গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা অপুষ্টিতে ভোগে এবং গর্ভকালে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এ কারণে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহবিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ