করোনায় গার্মেন্টস খাতে দেওয়া সরকারি প্রণোদনার মাত্র ১৬ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের। অথচ প্রায় ৪২ ভাগ শ্রমিক এখনো সেই প্রণোদনার অর্থ পায়নি। গার্মেন্টস খাতে প্রণোদনা বাবদ সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক ও ঋণ সহায়তা বাবদ ৬২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা পেয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ মাত্র শতকরা ১৬ ভাগ। এর মধ্যে আবার মোট শ্রমিকের ৪২ ভাগ বা প্রায় ১৪ লাখ শ্রমিক সরকারি প্রণোদনার অর্থ পায়নি। জানানো হয়, করোনার কারণে ৬৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ছাঁটাই হয়েছে ২১ হাজার শ্রমিক। কারখানা বন্ধ ঘোষণা ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর এক প্রতিবেদনে।
‘তৈরি পোশাক খাতে করোনা ভাইরাস উদ্ভূত সংকট : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এই অনলাইন ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে টিআইবি। এতে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। গত মে থেকে নভেম্বর মাস সময়ে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতকে দেওয়া বিভিন্ন অংশীজনের প্রণোদনা ও সহায়তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট প্রণোদনার ৯৮.৫৭ শতাংশ (প্রায় ৬১,৯৮০ কোটি টাকা) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দেওয়া হয়। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দেওয়া হয় মোট প্রণোদনার ১.৪০ শতাংশ (প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা) এবং বিভিন্ন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক ০.০৩ শতাংশ (প্রায় ১৯.৭১ কোটি টাকা)। সরকার কর্তৃক প্রদেয় মোট প্রণোদনার ৯৩.৯৬% (প্রায় ৫৯,০৯০ কোটি টাকা) ভর্তুকি সুদে ঋণ সহায়তা প্যাকেজের আওতায় দেওয়া হয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রণোদনার বেশির ভাগ কারখানা মালিককে ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলায় দেওয়া হয়। করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রদেয় প্রণোদনার প্রায় ৮৪ শতাংশ বা ৫২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেওয়া হয় তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থে। কিন্তু এপ্রিল-জুলাই পর্যন্ত তৈরি পোশাক শ্রমিকদের প্রাক্কলিত বেতন-ভাতা প্রায় ১২ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা হলেও সরকার প্রদেয় এই প্যাকেজে প্রণোদনার পরিমাণ ছিল নয় হাজার ১৮৮ কোটি টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৭.৬ শতাংশ কম। ফলশ্রুতিতে তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত মোট শ্রমিকের প্রায় ৪২.০২ শতাংশ (প্রায় ১৪ লাখ) বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি প্রণোদনার অর্থ পায়নি বা বঞ্চিত হয়।
ইইউ ও জার্মানি কর্তৃক পোশাক শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা সহায়তার তহবিল (শ্রমিক কল্যাণে আন্তর্জাতিক সহায়তার ৯৭.৭৯ শতাংশ বা ৮৭৫ কোটি টাকা) গঠনের প্রায় তিন মাস পর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী এ ক্ষেত্রে সরকার ও মালিকপক্ষের সংগঠনগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকা প্রণয়নে অনাগ্রহ ও দায়িত্বে অবহেলা ছিল। ফলশ্রুতিতে সম্ভাব্য
সুবিধাভোগী প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা সহায়তা এখনো পায়নি। তালিকা তৈরির পদ্ধতিগত জটিলতা থাকার কারণে তৈরি পোশাক খাতের মালিক সংগঠনগুলোর (বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ) বাইরে থাকা কারখানা ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রণোদনার অর্থ প্রাপ্তিতে বড় কারখানাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে প্রণোদনা প্রাপ্তিতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও তদবিরের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড়ের পদ্ধতিগত জটিলতার জন্য কারখানাগুলোর অর্থ প্রাপ্তিতে এক মাসের অধিক সময় ব্যয় হয়। ফলে শ্রমিকরা যথাসময়ে বেতন-ভাতা পায়নি এবং করোনা সংকটকালে মানবেতর অবস্থায় পতিত হয়। তা ছাড়া এমএফএস অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেতন উত্তোলনে সময় ও অর্থ তুলনামূলক বেশি ব্যয় হওয়ায় এ পদ্ধতি ব্যবহারে শ্রমিকরা অনাগ্রহ প্রকাশ করে। কিছু কারখানা লে-অফ ঘোষণা এবং করোনা সংকটের শুরুতে ছাঁটাই হওয়ায় প্রণোদনাপ্রাপ্ত ৬৪ কারখানার ২১ হাজার শ্রমিকের বেতন-ভাতা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোর জন্য কোনো নির্দেশনা না থাকায় সংশ্লিষ্ট প্রায় তিন হাজার কারখানার প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
প্রণোদনা বিতরণেও বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। ঋণের টাকা পরিশোধে বৃহৎ শিল্প খাতের জন্য দুই বছর নির্ধারণ করলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য তা এক বছর নির্ধারণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ প্রদানে অনাগ্রহ প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য গঠিত প্রণোদনা তহবিল ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষণীয়। অপরদিকে নতুন অর্থবছরে (২০২০-২১ অর্থবছর) পোশাক খাতের জন্য উৎস কর পূর্বের ০.২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ০.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করার ফলে এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
টিআইবি জানায়, গত এপ্রিল মাসে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি-ভাতা বিষয়ে সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় সভায় সাধারণ ছুটিকালীন শ্রমিকদের বেতনের ৬৫ শতাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উক্ত সভায় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী লে-অফকৃত কারখানার ৫০ শতাংশ মজুরি প্রদানের বিধান থাকলেও কারখানাগুলোর মালিক কর্তৃক অধিক হারে (অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ) মজুরি প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়।
তা ছাড়া ঈদ বোনাসের ক্ষেত্রে ঈদের আগে অর্ধেক এবং পরবর্তী ছয় মাসে বেতনের সঙ্গে বাকি অর্ধেক প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সরকার, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক মে মাস থেকে কর্মরত শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি নিয়মিত প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। গৃহীত সব পদক্ষেপে বাস্তবায়নে অনেকক্ষেত্রে ব্যত্যয় লক্ষ করা গেছে। অনেকক্ষেত্রে লে-অফ কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি ও ঈদ বোনাস অঙ্গীকার অনুযায়ী (৬৫ শতাংশ) প্রদান করা হয়নি। তা ছাড়া মে মাস থেকে শ্রমিকদের মজুরি নিয়মিত প্রদানের বিজিএমইএ কর্তৃক নির্দেশনা থাকলেও অনেকক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি দেওয়া হয়নি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার প্রাপ্য মজুরি ও ভাতা প্রদান করা হয়নি। ফলে করোনা উদ্ভূত সংকটে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা সংকটকালে ৭৭ শতাংশ শ্রমিক তাদের পরিবারের সব সদস্যের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না (ব্র্যাক, ২০২০)। অপর একটি গবেষণায় করোনা সংকটের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মার্চ-মে পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি ও ঈদ বোনাসের ক্ষেত্রে ‘ওয়েজ গ্যাপ’ প্রাক্কলন করা হয় যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কারখানা লে-অফ ও শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মালিক সংগঠন ও মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় এবং বিজিএমইএ কর্তৃক কারখানার মালিকদের শ্রমিক ছাঁটাই না করে বকেয়া মজুরির কম অংশ প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিশেষ কারণে কারখানার মালিক কর্তৃক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে দুই মাসের বেতনের সম-পরিমাণ অর্থ প্রদানের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই তা প্রতিপালন করা হয়নি।
তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিজিএমইএর ৩৪৮টিসহ মোট এক হাজার ৯০৪টি কারখানা লে-অফ ও বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং প্রায় ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে একত্রে বহু সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই করা হলেও পরবর্তী সময়ে অল্প সংখ্যক নিয়মিত শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে। কারখানাগুলোতে ইচ্ছেকৃত ছাঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে কম বেতন ও মজুরি ছাড়া অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় কাজ করানো এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে সার্বিক পর্যবেক্ষণ অংশে টিআইবি বলে, তৈরি পোশাক খাতে সুশাসনের বিভিন্ন নির্দেশকে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি বিভিন্ন সময়ে উঠে এলেও তা নিরসনে সরকার ও মালিকপক্ষের সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি লক্ষণীয়। করোনার সময়ে এই প্রবণতা আরো প্রকট হয়েছে। চার দশক ধরে বিকশিত তৈরি পোশাক খাত এখনো প্রণোদনার ওপর নির্ভরশীল; মালিকপক্ষ সরকারের ওপর প্রভাব ও চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের সুবিধা আদায় করে। করোনার মতো সংকট মোকাবিলায় এ খাতের নিজস্ব সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। মালিকপক্ষ ব্যবসার সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রণোদনা আদায় করলেও শ্রমিকদের অধিকার, সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কোনো প্রকার পরিকল্পনা ও কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করেনি। করোনা সংকটকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়নি এবং দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে বরং কারখানার মালিকদের চাপ প্রদান ও নৈতিক ব্যবসা না করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
করোনা সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে কারখানা লে-অফ ঘোষণার প্রবণতা লক্ষণীয়। সর্বোপরি করোনা সংকটের কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়; সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এ খাতে সরকার কর্তৃক বিপুল প্রণোদনা ও সহায়তা প্রদান করে যার ক্ষুদ্র অংশ শ্রমিকরা পেয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে তৈরি পোশাক খাতে করোনা ভাইরাস উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় নয়টি সুপারিশ করে টিআইবি।
আপনার মতামত জানানঃ