ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম সমন্বয়ের জন্য বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) দেওয়া এক চিঠিতে লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়িয়ে সয়াবিন তেলের দাম ১৮৫ টাকা থেকে ২০৫ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া খোলা সয়াবিন তেল ১৬৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮০ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯১০ টাকা থেকে ৯৬০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে ভোজ্যতেলের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
তাই ডলারের বাড়তি দাম অনুযায়ী তেলের মূল্য সমন্বয়ের জন্য বলা হয়েছে। গত ৩ আগস্ট আমরা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। সেটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তসলিম শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি ১৫ দিন পরপর তেলের দামের একটা রিভিউ হয়। ডলারের যে অ্যাডজাস্টমেন্ট সেটা আমরা দিতে বলেছি। ট্যারিফ কমিশনে প্রস্তাবটি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনেরর উপ-প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন আমাদের কাছে তেলের তাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এটা তারা নিয়মিত প্রতি মাসেই করে। তাদের আবেদনটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমার কাছে আসবে, এরপর আমরা সেটি পর্যালোচনা করবো। তারা প্রস্তাবনায় ১০০ টাকাও বাড়ানোর কথা বলতে পারে। কিন্তু পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।
সর্বশেষ গত ২১ জুলাই তেলের দাম কমিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সেসময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৬ টাকা, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৫ টাকা এবং ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সয়াবিন তেলের পাশাপাশি পাম তেলের দামও ৬ টাকা কমানো হয়। পাম তেলের নতুন দাম ১৫২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ঝুঁকিতে মধ্যবিত্তের ভবিষ্যত
এদিকে, রাজধানীর মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করেন মোস্তাক আহমেদ। বেতন পান সবমিলিয়ে ১৮ হাজার টাকা। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরের কাজীপাড়ায়। বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মোস্তাক।
রোববার (৭ আগস্ট) আলাপকালে মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কিন্তু সে অনুযায়ী চাকরিজীবী বা অন্যান্য পেশার লোকজনের আয় বাড়েনি। এমন অবস্থায় অনেকের জন্যই ঢাকায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে।
মোস্তাক আহমেদ বলেন, বেতনের একটি বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। নিজের পছন্দের খাবার বা পোশাক কেনা সম্ভব হয় না। মাস শেষ হওয়ার আগেই ধার-দেনা করতে চলতে হয়। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?
শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রতি লিটার ডিজেলে বেড়েছে ৩৪ টাকা, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে বেড়েছে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকায়। এছাড়া প্রতি লিটার কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ ও পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আজ (রোববার) থেকে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।
গুলশানে একটি সুপার শপে কাজ করেন সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা ইমদাদ হাসান। রোববার (৭ আগস্ট) সকালে আলাপকালে তিনি বলেন, ছাত্র অবস্থায় তিনটা টিউশনি করতাম। তখন মাসে আট-নয় হাজার টাকা আয় হতো। এই টাকার একাংশ দিয়ে মেসে থাকতাম। বাকি টাকা টাঙ্গাইলে বাড়িতে পাঠাতাম মা-বাবার হাত খরচের জন্য। এখন ১৪ হাজার টাকা বেতন পাই। কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ায় মেস ভাড়া, খাবার খরচ, পকেট খরচ দিয়ে মাস শেষে তেমন কিছুই থাকে না। বাড়িতেও ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারি না।
মহাখালীর আমতলী কাঁচাবাজার থেকে ৭০ টাকা দিয়ে একটি লাউ, ৬০ টাকা কেজিতে পটল ও করলা, ৩০ টাকা কেজিতে আলু কিনে বাসায় ফিরছিলেন সেকান্দার আলী। জাগো নিউজকে তিনি জানান, তিনদিন আগেও এই বাজার থেকে শাকসবজি কিনেছেন আরও কম দামে। এখন তেলের দাম বাড়ায় প্রতিটি সবজিতেই পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন দোকানিরা।
তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ায় শুধু কাঁচাবাজার নয়, জীবনযাত্রার সবক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে না খেয়ে দিন পার করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অপুষ্টিতে ভুগবে।
বাড্ডা লিংক রোডে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিলেন সোহেল রানা। আলাপকালে তিনি জানান, পাইকারি বাজার থেকে তারা সবজি কিনে আনেন। পাইকাররা সব সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তারাও সবজি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি বলেন, বেশি দামে সবজি বিক্রি করলেও আমাকেই আবার চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ বা মাংস বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দেশের সব মানুষ এমন চক্রাকারে আটকে গেছে।
তেলের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রথমেই ধাক্কা খাবে পরিবহন সেক্টরে। আর পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে বাড়বে পণ্যের দামও। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ