পাকিস্তানের অংশে থাকা থর মরুভুমির বুকে শুয়ে আছে উমরকোট জেলা। এক সময় এই উমরকোট শাসন করতেন হিন্দু সোধা রাজপুতেরা। জেলাটির সদর শহরের নামও উমরকোট। ভারত সীমান্ত থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। থর মরুভূমি দিয়ে ঘেরা উমেরকোট শহরের ঠিক মাঝখানে। নীল আকাশের বুকে মাথা তুলেছে, লাল ইঁটের তৈরি এক ঐতিহাসিক দুর্গ। পাকিস্তানের পর্যটন দফতরের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, দুর্গটি বানিয়েছিলেন সুমরো রাজা উমর।
দুর্গের কিছুটা ভেতরে প্রবেশ করার পর, দেখা যাবে লাল পাথরের তৈরি ছোট একটি কাঠামো। সামনের ফলকটিতে লেখা আছে, শের শাহ সুরির কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন ধরেছিলেন পারস্যের পথ। একসময় পৌঁছেছিলেন উমরকোটে। বিধ্বস্ত ও হতাশ হুমায়ুনকে উমরকোট দুর্গে আশ্রয় দিয়েছিলেন উমরকোটের রানা প্রসাদ সিং সোধা।
দুর্গের এই স্থানে, ১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর, জন্ম নিয়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী মুঘল সম্রাট আকবর। এই উমরকোট দুর্গের ভেতরে আছে একটি মিউজিয়াম। সংগ্রহশালাটির একটি ঘর চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে দেশ বিদেশের পর্যটককে। সেখানে অসংখ্য পুতুলের সাহায্যে এক হিন্দু নারীর মর্মস্পর্শী কাহিনী বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কে এই নারী, যার নাম আজো ঘুরে পাকিস্তানের ঘরে ঘরে এবং যার কাহিনী ‘শাহ জো রিসালো’ গ্রন্থে লিখে গেছেন বিখ্যাত সিন্ধি সুফি কবি শাহ আব্দুল লতিফ ভিট্টাই।
১৪০০ শতাব্দীর মধ্যভাগ। থর মরুভূমির দক্ষিণ অংশে থাকা মালি গ্রামে, স্ত্রী মাদুই ও কন্যা মারভিকে নিয়ে বাস করতেন পশুপালক পালিনি মারাইচ। পালিনির কিশোরী কন্যা মারভি ছিল অসামান্য রূপসী। তার রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকার গ্রামগুলোতে। পশু চরিয়ে মারভির দুধে আলতা রঙ তামাটে হতে থাকায়, ফগসেন নামে এক রাখাল কিশোরকে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন পালিনি’কে। বয়সে ফগসেন ছিল মারভির থেকে দুই বছরের বড়। একসঙ্গে বড় হওয়ার পর, হঠাৎই ফগসেন যুবতী মারভিকে দিয়েছিলেন বিয়ের প্রস্তাব।
স্তম্ভিত মারভি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব। কারণ ফগসেনকে তিনি দাদা ভাবতেন। স্ত্রী মাদুইয়ের কাছ থেকে ঘটনাটি শোনার পর, ফগসেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন পালিনি। কারণ গ্রামেরই এক রূপবান যুবক খেতসেনের সঙ্গে মারভির বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল। তবে মারভির প্রত্যাখ্যান এবং পালিনির করা অপমান ভুলতে পারেননি যুবক ফগসেন। তাই বদলার আগুন দাবানল হয়ে জ্বলতে শুরু করেছিল ফগসেনের বুকে।
সেই সময় উমরকোট শাসন করছিলেন সুমরা রাজা উমর সুমরু। সুদর্শন ও সহৃদয় রাজা উমর, ধর্মে ছিলেন ইসমাইলি শিয়া। প্রজাদের সুখ দুঃখের খবর রাখতেন। তবে সুন্দরী নারীদের প্রতি তার ছিল অসীম দূর্বলতা। অসংখ্য রূপসী আলোকিত করে রাখতেন রাজা উমরের অন্ধকার হারেম। তীব্র আক্রোশ নিয়ে ফগসেন একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজা উমরের দরবারে।
রাজাকে বলেছিলেন, জানেন কি বিশ্বের সেরা সুন্দরী আপনারই প্রজা? নাম তার ‘মারভি’। এখনও সে কুমারী। কয়েকদিন পরেই তার বিয়ে হয়ে যাবে। তাই তার আগেই, আপনি সেই রূপসীকে প্রাসাদে তুলে আনুন। এই পৃথিবীতে একমাত্র মারভিই আপনার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য। ফগসেনের কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন রাজা। কারণ তার হারেমে অনেক ডানাকাটা পরী থাকলেও, রাজা উমর তখনো ছিলেন অবিবাহিত।
উঠের পিঠে চড়ে সেই রাতেই ছদ্মবেশী উমর পৌঁছে গিয়েছিলেন মালি গ্রামে। সঙ্গে ছিলেন ফগসেন। তখন ছিল শীতকাল। গ্রামের বাইরে উমর কাটিয়েছিলেন থরের হিমশীতল রাত। একসময় সূর্যের আলো এসে পড়েছিল মালি গ্রামের ওপর। জেগে উঠেছিল গ্রাম। গবাদিপশু নিয়ে পুরুষেরা বেরিয়ে পড়েছিলেন চারণভূমির খোঁজে। ক্রমশ বাড়ছিল সুর্যের তেজ। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন রাজা উমর। হঠাৎই ফগসেনের নজর পড়েছিল এক নারীর ওপর। চুমকি গাঁথা থারি পোশাক পরা নারীটির মাথায় ছিল পানির কলসি।
ফগসেন রাজা উমরের কানে ফিশফিশ করে বলেছিলেন, এই সেই মারভি। কথাটি বলেই ফগসেন লুকিয়ে পড়েছিলেন কাঁটা ঝোপের পিছনে। উট থেকে নেমে উমর এগিয়ে গিয়েছিলেন মারভির দিকে। দূর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, আমায় একটু পানি দেবে? ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। তৃষ্ণার্ত পথিককে ফিরিয়ে দেওয়া নিষেধ। তাই মারভিও এগিয়ে এসেছিলেন উমরের দিকে। মারভির রূপের তেজ ছিল সূর্যের থেকেও প্রখর। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উমর।
মারভি কাছে আসা মাত্র, মরুকন্যাকে উটে তুলে নিয়েছিলেন রাজা উমর। চিৎকার করে উঠেছিলেন মারভি, বাঁচাও, ডাকাত আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মারভির সেই আর্ত চিৎকার শুনে, গ্রামের মহিলারা বেরিয়ে আসার আগেই, রাজার উট ছুটেছিল উমরকোট দূর্গের দিকে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিলেন মারভি। মরুকন্যার চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিল মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বালি।
উমরকোট দুর্গের একটি প্রাসাদের সামনে থেমেছিল রাজার উট। দাসীরা এসে ঘিরে ধরেছিল মারভিকে। নিয়ে গিয়েছিল প্রাসাদের সবথেকে সুন্দর ঘরটিতে। তখনও কেঁদে চলেছিলেন মারভি। রত্নখচিত অলঙ্কার, দামি পোশাক ও সুগন্ধী খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল দাসীরা। সেদিকে ফিরেও তাকাননি মারভি। দেওয়ালে মুখ গুঁজে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছিলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর, এসেছিলেন উমর। নরম গলায় মারভিকে বলেছিলেন, এভাবে তুলে আনার জন্য তিনি দুঃখিত। কিন্তু তিনি মারভির রূপে মুগ্ধ। তাই মারভিকে তিনি স্ত্রীয়ের সম্মান দিতে চান। মারভি এই প্রস্তাব মেনে নিলে, উমরকোট একদিন শাসন করবে রানি মারভির পুত্র। উন্নতি হবে মারভিদের গ্রামেরও। উমরের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন মারভি। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, রাজা আমি অন্যের বাগদত্তা। আমি আপনার স্ত্রী হতে পারিনা। আমার দরকার নেই রাজ প্রাসাদ।
খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে আমার কাছে অনেক দামি। দয়া করে আমাকে আমার গ্রামে দিয়ে এসো। তোমার দুটো পা ধরছি। শান্তভাবে মারভিকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন রাজা উমর। কিন্তু মারভি তখনও রাজার পা ধরে বলে চলেছিলেন, রাজা, তোমার দেওয়া গয়নার থেকেও, পুঁতির মালা আমার কাছে দামি। আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু তোমার থেকেও সুখী। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছিল রাজার। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ঠিক আছে। যতদিন রাজি না হও, ততদিন বন্দি থাকো এই ঘরে।
এরই মধ্যে গ্রামের লোকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল মারভির খবর। তবে রাজার বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা ছিল না গরীব গ্রামবাসীদের। তাই চোখের পানি ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না মারভির বাবা মায়ের। ওদিকে, রাজা উমর প্রতিদিন দামি উপহার নিয়ে আসতেন মারভির জন্য। বিভিন্নভাবে বোঝাবার চেষ্টা করতেন মারভিকে। কারণ অনুমতি ছাড়া কোনো নারীকে বিবাহ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাজা মারভিকে বলতেন, দেখো তোমার পরিবারও ভুলে গেছে তোমাকে। নয়ত একবার অন্তত আসত আমার কাছে।
মারভি তার সাগর গভীর চোখ তুলে বলতেন, তুমি রাজা, তোমার বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা শান্তিপ্রিয় গ্রামবাসীদের নেই। তারা যে আকাশের মতো নির্মল। তাদের মনে পাপ নেই। পরের মেয়েকে তারা জোর করে তুলে আনে না। ধৈর্য হারিয়ে রাজা উমর অপমান করতেন মারভিকে। তবুও প্রতিদিন রাজার পায়ে লুটিয়ে, গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন মারভি। ছুঁয়েও দেখতেন না উমরের আনা উপহার।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। মারভির কাছে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন রাজা উমর। খাঁচায় বন্দি পাখির মতো দিন কাটত মারভির। ঘরে বিলাসবহুল বিছানা থাকা সত্ত্বেও, শীতের রাতে মারভি শুতেন কনকনে ঠাণ্ডা পাথরের মেঝেতে। যে পোশাক পরে প্রাসাদে ঢুকেছিলেন, সেই পোশাক পরেই থাকতেন। গোসল করতেন না। চুল আঁচড়াতেন না। দাসীরা লোভনীয় খাবার দিয়ে গেলেও, রোজ একটি মাত্র বাজরার রুটি পানিতে ভিজিয়ে খেতেন।
জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন শেষ করে দেওয়ার কথাও মাঝে মাঝে ভাবতেন মারভি। কিন্তু হিন্দু ধর্মে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। তাই তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলেন মারভি। প্রাসাদের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরের দিকে। ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখিদের দেখলেই কান্না পেত তার। নিজেকেই প্রশ্ন করতেন, কেন ঈশ্বর আমাকে পাখি করলেন না? সত্যিই কি আমাকে ভুলে গেছে বাবা মা? ভুলে গেছে খেতসেন? মৃত্যুর আগে একবারও কি দেখা হবে না তাদের সঙ্গে?
এভাবেই মারভির চোখের পানিতে ভিজে বিদায় নিয়েছিল বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত। থর মরুভূমির বুকে আবার পা রেখেছিল হাড় কাঁপানো শীত। রাজ্য শাসনের কাজে ব্যস্ত থাকায়, মারভিকে ভুলেই গিয়েছিলেন রাজা উমর। কিন্তু এক হিমেল ভোরে, হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল মারভির কথা। পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই ঘরের সামনে, যে ঘরে এক বছর ধরে বন্দি ছিল মারভি। জানলা দিয়ে মরুকন্যাকে দেখে চমকে উঠেছিলেন উমর। এ কোন মারভি! কঙ্কালসার দেহ। পরনে ময়লা জমে কালো হয়ে যাওয়া পোশাক। মাথার চুলে জট।
চোখের চারপাশে জমেছে কালি। গায়ের দুধে আলতা রঙ হয়েছে ফ্যাকাশে সাদা। ঘরের এক কোনে বসে, পাগলের মতো বিড়বিড় করছিলেন মারভি। ঘরের ভেতর পায়ের আওয়াজ পেয়ে, ঘুরে তাকিয়েছিলেন মারভি। এক বছর পর রাজাকে দেখে, আবার চোখ দুটো ভরে উঠেছিল পানিতে। অনেক কষ্টে উঠে এসে, রাজার পায়ের সামনে বসে পড়েছিলেন মারভি। চোখে ছিল পানি, কিন্তু মুখে ছিল হাসি। হাঁফাতে হাঁফাতে মারভি বলেছিলেন, আপনাকে আর কষ্ট দেব না রাজা। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর হয়তো কয়েকটা মাস। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? দয়া করে আমার মৃত্যুর পর, দেহটা পাঠিয়ে দেবেন আমার গ্রামে।
আমি জানি, চিতায় ওঠার সম্মান পাবো না। আপনি আমাকে গ্রামের মাটিতে কবর দেবেন। আমার এই তুচ্ছ শরীরটাকে আবার আঁকড়ে ধরবে সোনালি মাটি। মরে গিয়েও বুনো ফুল হয়ে বেঁচে থাকব আমি। সেই প্রথম নিজের হৃদয়ে এক মোচড় দেওয়া যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন রাজা উমর। সেই প্রথম বুঝেছিলেন, ক্ষমতার জোরে দেহ কেনা যায়। মন পাওয়া যায় না। অনুতপ্ত উমর উট সাজাতে বলেছিলেন। তাজা বাতাস নিয়ে এসেছিল মুক্তির সুঘ্রাণ। মারভির চোখের পানিতে সেদিনও ভেসে গিয়েছিল উমরের জরি দেওয়া নাগরা জুতা। তবে সে অশ্রু ছিল মুক্তির আনন্দের।
মারভিকে নিয়ে রাজার সুসজ্জিত উট একসময় পৌঁছে গিয়েছিল মালি গ্রামে। কিন্তু বিধাতার কি নির্মম পরিহাস। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলেছিলেন, বিধর্মী রাজার সঙ্গে এক বছর কাটিয়ে অস্পৃশ্য হয়ে গেছে মারভি। তাই গ্রামে সে প্রবেশ করতে পারবে না। মারভির হবু স্বামী খেতসেন ও গ্রামবাসীদের বিদ্রুপের তির ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল মারভিকে। ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন বাবা পালিনি ও মা মাদুই। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বালির মধ্যে বসে থাকা মারভি বুঝেছিলেন, যে গ্রামের জন্য নিজেকে তিলে তিলে শেষ করতে বসেছিলেন। সে গ্রাম তার নিজের নয়।
সেনারা ফিরে গিয়ে উমরকে জানিয়েছিল মারভির লাঞ্ছনার কথা। ক্রোধে উন্মত্ত উমর, সব কাজ ফেলে, বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মারভির গ্রামে। মরুভূমির দিক থেকে কয়েক হাজার উটকে ছুটে আসতে দেখে, গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলেন সবাই। গ্রামে ছিলেন একা মারভি। মাথা নিচু করে তিনি তখন এগিয়ে চলেছিলেন গ্রামের বাইরে থাকা কুয়োটার দিকে। রাজা বুঝেছিলেন, নিজের জীবন শেষ করে দিতে চলেছে মারভি। দৌড়ে গিয়ে উমর দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন মারভির সামনে। তার আদেশে কুয়োটিকে ঘিরে ফেলেছিল সেনারা।
জলে ভরা চোখ দুটি তুলে মারভি রাজাকে বলেছিলেন, সব শেষ, এখন কেন এসেছেন রাজা? গ্রামের লোকদের হত্যা করার জন্য? কিন্তু ওরা তো কোনো অন্যায় করেনি। আপনি করেছিলেন। আপনার জন্যেই আজ আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে প্রিয়জনেরা। ওরা কী করে জানবে আমি আজো কুমারী? কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার সেনারা ধরে এনেছিল গ্রামবাসীদের। গ্রামের মুখিয়ারা উমরকে বলেছিলেন, আপনি বিধর্মী, আপনার স্পর্শে অপবিত্র হয়ে গেছে মারভি। তাই আমরা তাকে গ্রামে ঢুকতে দেব না শান্ত গলায় রাজা বলেছিলেন, মারভি আজো আকাশের মত পবিত্র।
মুখিয়ারা এরপর বলেছিলেন, নিজেদের পবিত্রতা প্রমাণ করার জন্য, দুজনকেই দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা। খালি পায়ে হাঁটতে হবে জ্বলন্ত কাঠ কয়লার ওপর দিয়ে। হাতজোড় করে উমর বলেছিলেন, আমি একাই দেব অগ্নিপরীক্ষা। দয়া করে মারভিকে আর কষ্ট দেবেন না। রাজি হননি গ্রামবাসীরা। তাই গ্রামবাসীদের কথাই মেনে নিয়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী উমরকোট রাজ উমর সুমরু। সেনাদের দিয়েছিলেন প্রাসাদে ফেরার আদেশ। বালির বুকে খোঁড়া হয়েছিল লম্বা একটি গর্ত। সেই গর্ত বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল জ্বলন্ত কাঠকয়লা দিয়ে।
ফুলকি ওড়াতে থাকা জ্বলন্ত কাঠকয়লার ওপর দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে গিয়েছিলেন মারভি। পবিত্র মরুকন্যার নিদারুণ এই লাঞ্ছনা দেখে বুঝি বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল কাঠকয়লার টুকরাগুলো। অক্ষত পায়ে মারভি পেরিয়েছিলেন অগ্নিকুণ্ড। পায়ের নাগরা খুলে ফেলেছিলেন রাজা উমর। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন মারভি। খালি পায়ে জ্বলন্ত কাঠকয়লার ওপর দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে গিয়েছিলেন উমর। গ্রামবাসীদের উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল সন্ধ্যার থর। সেই রাতেই মারভি ও খেতসেনের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন গ্রামবাসীরা।
রাত তখন গভীর। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। নাচ গান আনন্দে মেতে উঠেছিল মালি গ্রাম। উচ্চকণ্ঠে পুরোহিত পড়ছিলেন মন্ত্র। মালা বদল করছিলেন খেতসেন ও মারভি। ঠিক সেই মুহূর্তে, গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে থাকা এক বালিয়াড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজা উমর সুমরু। উমরের শক্ত মুঠোয় ধরা ছিল উন্মুক্ত তরবারি। মরুভূমির রাতকে বিশ্বাস নেই তার। কারণ রাতের থরে শুরু হয় দস্যুদের আনাগোনা। তাই তাকে জাগতেই হবে এই রাত। মরুকন্যা মারভির জন্য। রাজা উমর সুমরুর চোখের পানিতে ভিজেছিল রাতের থর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ