২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বরিস যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন, তা ১৯৮৭ সালের পর আর কেউ পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের অনমনীয় অঙ্গীকারের কারণে দলটিতে তার নেতৃত্ব এতটাই সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল, আপাতত ‘তার কোনো বিকল্প নেই’ বলেই দলটির সমর্থকেরা বলে আসছিলেন।
তার জায়গায় কে আসবেন—সে কথা কেউই এখন বলতে পারছে না, যেমনটি বলা হতো টনি ব্লেয়ারের বিকল্প গর্ডন ব্রাউন কিংবা ডেভিড ক্যামেরনের বিকল্প থেরেসা মে অথবা বরিস জনসন। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মিথ্যা বলা বা নিজের তৈরি আইন নিজে না মানার অভিযোগে মাস দুয়েক আগেও তাকে দলের এমপিরা পদচ্যুত করতে চাননি।
যেসব কেলেঙ্কারি অন্য যে কোন রাজনীতিককে ডুবিয়ে দিতে পারতো, বরিস জনসনের ওপর যেন সেগুলোর কোন প্রভাবই পড়তো না। তিনি বার বার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন। একঘেয়ে, যান্ত্রিক রাজনীতিকদের যুগে তিনি ছিলেন রীতিমত একটা চরিত্র। তার অবিন্যস্ত সোনালি চুল এবং ক্ষ্যাপাটে ব্যক্তিত্ব তাকে ব্রিটিশ ভোটারদের এমন এক অংশের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, যা অন্য কোন রাজনীতিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লন্ডনের মতো বাম-ঝোঁকা রাজনীতির নগরীতে তিনি কনসারভেটিভ পার্টি থেকে দুই দুই বার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৬ সালে ব্রিটেনে যে গণভোট হয়েছিল, সেখানে তিনিই ছিলেন ব্রেক্সিটপন্থীদের প্রধান নেতা। এরপর ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি যে বিপুল ভূমিধস বিজয় পান, সেটি কনসারভেটিভ পার্টির সহকর্মীদের মধ্যে তার এমন এক স্থায়ী ভাবমূর্তি তৈরি করে, যে কোন নির্বাচনে যার স্পর্শে বুঝি সহজেই জয় পাওয়া যায়
কিন্তু সেই নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের সমর্থন হারিয়েই বিদায় নিতে হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। বৃহস্পতিবার নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন বরিস। এর আগে মন্ত্রিসভা থেকে একে একে ২৭ জন পদত্যাগ করার পর নড়বড়ে হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চেয়ার।
বরিসকে যে সরে যেতে হবে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয় গত কয়েক দিনে সরকারের বিভিন্ন স্তরের মন্ত্রী ও আধিকারিকদের লাগাতার ইস্তফার পর। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনকের ইস্তফার পর যাঁকে সেই পদে বসানো হয়, তিনি-ও বরিসের ইস্তফার দাবি করতে থাকেন। সরকারের বিভিন্ন স্তরের মন্ত্রী ও আধিকারিক মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের ইস্তফার পর শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে সম্মত হন বরিস।
কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো এবং এর নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। প্রতিবেদনে বরিস জনসনের ক্ষমতা হারানোর পেছনে পাঁচটি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ক্রিস পিনচার কেলেঙ্কারি
গত ২৯ জুন লন্ডনে একটি ক্লাবে ব্রিটিশ এমপি ও কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচারের বিরুদ্ধে দুজন পুরুষকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। এর জের ধরে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক বছরের পুরোনো যৌন অসদাচরণের অভিযোগও বেরিয়ে আসে। এতে নতুন করে চাপে পড়েন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আগে থেকেই আরও অনেক কেলেঙ্কারি সামাল দিচ্ছিলেন তিনি।
পিনচারের বিষয়গুলো জানার পরও বরিস তাঁকে কনজারভেটিভ ডেপুটি চিফ হুইপ করেছিলেন, সে জন্য নিজের দলের এমপিরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রকাশ্যে। ৪ জুলাই বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী জনসন পিনচারের বিরুদ্ধে ওঠা অন্তত একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে জানতেন।
পরদিনই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা লর্ড ম্যাকডোনাল্ড জানান, তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীকে পিনচারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এর পর জনসন স্বীকার করেন, ২০১৯ সালে পিনচারের বিষয়ে তাঁকে জানানো হয়েছিল। পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষমা চান তিনি।
পার্টি কেলেঙ্কারি
এ বছরের এপ্রিলেই প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা গুনতে হয়েছে ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যজুড়ে কড়া লকডাউনের বিধিনিষেধ কার্যকর থাকা অবস্থায় জন্মদিনের পার্টির আয়োজন করে নিয়ম ভাঙার কারণে। বরিস জনসনই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আইনভঙ্গের জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারি ঠেকাতে প্রথমবার আরোপিত লকডাউনের সময় ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে পার্টি করে কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। পরের বছর গণমাধ্যমে ওই খবর প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়ে ক্ষমাও চান প্রধানমন্ত্রী জনসন।
মূল্যস্ফীতি ও করের বোঝা
বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অনেক দেশের মতো যুক্তরাজ্যেও চলতি বছর মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বেড়েছে। বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ এ সূচক দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার অনেকগুলো কারণই ছিল জনসনের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করায় জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ব্রিটিশ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলের ওপর থেকে শুল্ক কমানোসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এপ্রিলে কর হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
নতুন কর হারে ব্রিটেনে ৩৪ হাজার পাউন্ডের বেশি আয়ের জন্য আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হচ্ছে।
ওয়েন প্যাটারসন বিতর্ক
২০২১ সালের অক্টোবরে হাউস অব কমনস কমিটি তৎকালীন কনজারভেটিভ এমপি ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করে। কমিটি জানায়, ওয়েন প্যাটারসন লবিং করতে গিয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। তিনি অর্থের বিনিময়ে কিছু কোম্পানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এর পর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কনজারভেটিভরা প্যাটারসনের বিরুদ্ধে এই বহিষ্কারাদেশ স্থগিত রাখার পক্ষে ভোট দেয় এবং তদন্ত কীভাবে পরিচালিত হয়েছে তা অনুসন্ধানে আরেকটি নতুন কমিটি গঠন করে। শেষে প্রতিবাদের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ওয়েন প্যাটারসন।
পরিকল্পনাহীনতা
ব্রেক্সিট ইস্যুতে ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ অর্থাৎ ব্রেক্সিট কার্যকর করার নীতির ওপর ভর করে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বরিস জনসন। তবে এর পর থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে উদাসীনতা ও যথাযথ পরিকল্পনা ঘাটতি দেখা দেয় বলে জনসনের সমালোচকদের দাবি।
বরিস জনসনের সাবেক উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস (বর্তমানে জনসনের প্রধান সমালোচক) বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে প্রধানমন্ত্রী একটি নিয়ন্ত্রণহীন শপিং ট্রলিতে পরিণত হয়েছেন। অন্যান্য সমালোচকেরাও প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে আদৌ তার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা আছে কিনা। গত জুনে কনজারভেটিভ এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘সততা, দক্ষতা ও লক্ষ্যের’ অভাবে ভুগছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ