সময়টা ছিল ১৫২৭ সাল। প্রথম মোঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন তখন গুরুতর অসুস্থ। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করেও সুস্থ হচ্ছিল না। দেশের বড় বড় কবিরাজেরা হাজার চেষ্টা করেও ভালো করতে পারছে না।
এই অবস্থায় একদিন মোঘল সম্রাট বাবর এসে দাঁড়ালেন অসুস্থ হুমায়ুনের মাথার কাছে। আদরের ছেলের দীর্ঘ অসুস্থতা তাকে স্থির থাকতে দেয়নি কদিন। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। তিনটি প্রদীপ জ্বলছে মিটিমিটি। সম্রাট বসলেন ছেলের মাথার কাছে দীর্ঘ প্রার্থনায়। মনে মনে বলতে লাগলেন, হুমায়ুনের সব ব্যাধি আমি নিজের শরীরে ধারণ করলাম। হে পরম করুণাময়, তুমি আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও। তারপরই ঘটল সেই অলৌকিক ঘটনা।
হিন্দুস্থানের বাদশার কাতর প্রার্থনায়, তার সন্তানস্নেহের সামনে হার মানলো নিয়তিও। সত্যি সত্যিই সেই অদ্ভুত অসুখ থেকে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলেন সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন। আর অন্যদিকে যেন পুত্রের ব্যাধি শরীরে ধারণ করে ৫০ বছর বয়সে ১৫৩০ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর তিন দিন পর সম্রাট হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে বসলেন হুমায়ুন। আর তারপরেই ঘটতে লাগল একের পর এক বিচিত্র সব ঘটনা।
মোঘল ইতিহাসে সে এক ঘটনাবহুল সময়। এমনিতেই হুমায়ুন প্রথম থেকে রাজ্য পরিচালনায় ততটা মনোনিবেশ করতে পারেননি। কোমল হৃদয় আর অত্যন্ত খামখেয়ালি স্বভাবের এই সম্রাট ছিলেন কিছুটা অলস প্রকৃতিরও। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহনের সঙ্গে সঙ্গেই তার সৎ ভাই কামরান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তবে হুমায়ুন তাকে বাধা দিতে চাননি, ফলে যা হওয়ার তাই হয়।
কামরান সিন্ধু নদ অতিক্রম করে পাঞ্জাব দখল করে নেন। কাবুল-কান্দাহার ও পাঞ্জাব মির্জা কামরানের দখলে চলে আসে। হুমায়ুনের এই নিষ্ক্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে গুজরাটের অধিপতি বাহাদুর শাহ মহম্মদ জামান মির্জা আর তার সেরা বন্দুকবাজ রুমি খানেট শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন হুমায়ুনের বিরুদ্ধে। প্রথমে বাহাদুর শাহ মেবারের রানার সাহায্যে মালব দখল করেন। এরপর তিনি আহম্মদনগর, খান্দেশ ও বেরারের শাসকদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। এমনকি তিনি পর্তুগিজ নাবিকদের উপর জোরজুলুম করে করও আদায় করতেন বলে শোনা যায়।
বাহাদুর শাহ এতেও থেমে না থেকে বিদ্রোহী মোঘল আমিরদের আশ্রয় দেন। একের পর এক ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন হুমায়ুন। ঐ বছরই বাহাদুর শাহকে জব্দ করার জন্য তিনি গুজরাট আক্রমণ করেন। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল হুমায়ুনের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত হন বাহাদুর শাহ। ২৫ শে এপ্রিল হুমায়ুনের ভয়ে গুজরাটের মান্ড নগরী থেকে গা ঢাকা দেন তিনি। সেই সময়ই দেশের পূর্বাঞ্চলে আস্তে আস্তে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন এক উদীয়মান আফগান নেতা শের খান। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শের খান বাংলাদেশ আক্রমণ করে সুলতান মাহমুদ শাহকে পরাজিত করে রাজধানী গৌড় দখল করেন।
হুমায়ুন শেরখানের উত্তরোত্তর ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। তবে প্রথমেই শেরখানের অন্যতম ঘাঁটি চুনার দুর্গ অবরোধ করে বসলেন হুমায়ুন। এই চুনার দুর্গ বিয়ের যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন শেরখান। ‘হিস্ট্রি অফ দ্য আফগানে’ ডক্টর ডোরন এটাকে হুমায়ুনের অদূরদর্শিতার পরিচায়ক বলে মনে করেন। যাক সে কথা, এরপর বহু চেষ্টায় হুমায়ুন ১৫৩৮ সালে বাংলা আক্রমণ করেন এবং অধিকার করতে সক্ষম হন। সুজলা সুফলা বাংলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট হুমায়ুন সেসময় বাংলার নাম রাখেন ‘জন্নাতাবাদ’।
হুমায়ুন বাংলা জয় করলেন বটে, কিন্তু শেরখান ততদিনে বিহার ও জৈনপুরের মোঘল অঞ্চলগুলো জয় করে হুমায়ুনের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর ফলে হুমায়ুনের দিল্লি ফেরার পথ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। যে কোনো উপায়ে রাজধানীতে যে ফিরতেই হবে তা বুঝেছিলেন হুমায়ুন। কিন্তু বিধি বাম। আগ্রায় ফেরার পথে চৌসা নামক স্থানে শেরখানের সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মোঘল বাহিনীর উপর। চৌসার যুদ্ধে বিশ্রীভাবে হেরে যান হুমায়ুন। কোনো ভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন অন্য পথে। তবে ভাগ্য বিমুখ। অসতর্কভাবে পালাতে গিয়ে ঘোড়া নিয়েই হুমায়ুন পড়ে যান নদীতে। পানির নিচে যখন প্রায় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন ভারতসম্রাট, ঠিক তখনই প্রায় দেবদূতের মতন আবির্ভাব হয় নিজাম নামে এক ভিস্তিওয়ালার।
ভিস্তিওয়ালা নামটা শুনে চমকাচ্ছেন না কি! এই ‘ভিস্তি’ বা ‘ভিস্তিওয়ালা’- বড্ড পুরোনো, প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া একটা শব্দ। আজকের প্রজন্ম জানেই না ‘ভিস্তিওয়ালা’ বলতে কাদের বোঝায়? আসলে প্রাচীনকালের শহরগুলোয় আজকের মতো পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। পানির সরবরাহের জন্য শহর বা গ্রামবাসীদের ভরসা করতে হত একদল কর্মচারীর ওপর। এরাই ভিস্তিওয়ালা। ভিস্তি শব্দটি পার্সি ‘বিহিস্ত’ থেকে অপভ্রংশ হয়ে এসেছে, যার অর্থ স্বর্গ। পারস্য দেশের মানুষের বিশ্বাস ছিল বেহেস্ত বা স্বর্গের নদীর পানি এনে ভিস্তিওয়ালারা মানুষদের বিতরণ করে তাদের তেষ্টা মেটায়। বলা যায়, ভিস্তিওয়ালারা সেদেশের মানুষের চোখে প্রায় দেবদূতের সম্মান পেত।
এই পানি সরবরাহের কাজটা কীভাবে করত তারা? ভিস্তির জন্য ছাগলের আস্ত চামড়া দিয়ে তৈরি করা হত এক বিশেষ ধরণের ব্যাগ। এই ব্যাগকে বলা হত ‘মশক’। ছাগলের চামড়া গলা থেকে পায়ের অর্ধেক পর্যন্ত ছাড়িয়ে নিয়ে পুরো চামড়াটাকে পেট বরাবর সেলাই করা হত। পানি ভরার জন্য শুধু খোলা থাকত গলার কাছটা। ভিস্তিওয়ালারা এই বিশেষ চামড়ার ব্যাগে পানি ভরে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে দিতেন। মশক পানির ঠান্ডা রাখে। একটি মশকে আনুমানিক ৩০ লিটারের কাছাকাছি পানি ধরে।
এদেশেও সেই মোঘল আমলে ভিস্তিওয়ালাদের দেখা মিলত। ইতিহাস তাদের সে ভাবে মনে রাখেনি হয়তো, তবে এই নিজাম ভিস্তিওয়ালা অমর হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। পানি সরবরাহ করে তখন সবে বাড়ির পথ ধরেছিল সেই গরিব ভিস্তি। সম্রাটকে সে চিনতে পারেনি। একটা লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে দেখে তার ফাঁকা মশকটা সে ছুঁড়ে দেয় পানিতে। শেষ খড়কুটোর মতো নিজামের এই মশকে ভর করেই কোনো রকম পাড়ে উঠে আসেন হুমায়ুন।
সামান্য এক ভিস্তিওয়ালার দয়ায় সে যাত্রা জোর প্রাণে বেঁচে গেলেন সম্রাট। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে হুমায়ুন কৃতজ্ঞচিত্তে নিজামের সামনে দাঁড়ান। নিজের পরিচয় দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেন, দিল্লির মসনদ পুনরুদ্ধার করতে পারলে একদিনের জন্য হলেও ভারতের সুলতান করে দেবেন এই ভিস্তিওয়ালাকে। সম্রাটের জীবন বাঁচানোর যথোপযুক্ত ইনাম হবে সেটাই। এরপর কেটে গেছে চারমাস। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে দিল্লির সিংহাসন দখল করেছেন হুমায়ুন।
অন্যদিনের মতো সেদিনও আমির ওমরাহে পূর্ণ মোঘল সম্রাটের দরবার। এমন সময় বাইরে একজন লোককে দেখা গেল। খালি পা, গায়ে নোংরা চাদর, কাঁধে ছাগল-চামড়ার ভিস্তি, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। সে না কি সম্রাটের দর্শনপ্রার্থী! প্রধান প্রহরীকে নিজের পরিচয় দিয়ে সে বলল,’আমি সম্রাটের জীবন রক্ষাকারী। সম্রাট আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আমাকে একদিনের জন্য দিল্লির সিংহাসনে বসাবেন।’ প্রহরী তো রেগে কাঁই। এমন পাগলকে পারলে ঘাড় ধরেই বের করে দেয়। তবে বলা যায় না, এ লোক গুপ্তচর বা ঘাতকও হতে পারে। তাই লোকটাকে আটকে রেখে সে খবর পাঠাল বাদশাহকে। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ুন ভোলেননি কিছুই। লোকটার চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝলেন এই সেই ভিস্তিওয়ালা নিজাম, যে একদিন তার প্রাণরক্ষা করেছিল। বাদশা হুকুম দিলেন নিজামকে যথোপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে দরবারে নিয়ে আসতে।
ভিস্তিওয়ালা হুমায়ুনের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতেই সব সভাসদকে অবাক করে ছুটে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ভারতসম্রাট। বললেন, আপনার জন্যই আজ আমি জীবিত। বলুন আপনি কী চান? ভিস্তিওয়ালা বললেন, আমি গরিব মানুষ, সম্রাটের কাছে কিছু সাহায্য পাবার আশায় এসেছি। আপনি আবেগের বশে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমি জানি তার যোগ্য আমি নই। ভিস্তিওয়ালার কথা শুনে রহস্যের হাসি ফুটে উঠল হুমায়ুনের মুখে। আর একমুহূর্তও ভাবলেন না সম্রাট। আধাবেলা গড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। কিন্তু তা বলে বাদশার কথার খেলাপ হবে, তাই কি হয়! বাকি অর্ধেক বেলার জন্যই ভিস্তি নিজামকে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট।
হুমায়ুনের এহেন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েন সভাসদেরা। অত্যন্ত বিরক্ত হন ভাই কামরান মির্জা। একজন সামান্য ভিস্তিওয়ালাকে কিনা বসানো হবে মোগল সিংহাসনে! এ কেমন ধারা পাগলামো! সম্রাটের প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাকে ধনরত্ন দেওয়া যেতে পারে, জায়গির দেওয়া যেতে পারে। সিংহাসন কেন? তবে হুমায়ুনও নাছোড়বান্দা। কারও কথাতেই কানে নিতে রাজি নন তিনি। মতবিরোধ একসময় চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছয়। সব সভার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন হুমায়ুন। মাথার তাজ খুলে নিজাম ভিস্তিওয়ালাকে পরিয়ে দেন নিজ হাতে। তারপর তাকে সিংহাসনে বসিয়ে সভাসদকে জানিয়ে দেন ‘আজ ইনিই হিন্দুস্থানের বাদশাহ। আমি এঁর নগণ্য এক খাদেম’।
বলাই বাহুল্য, পুরো দিল্লিতে তোলপাড় পড়ে গেছিল হুমায়ুনের এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে। বাদানুবাদের ঝড় বয়ে গেছিল। প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করা হয়েছিল হুমায়ুনকে। প্রতিবার একই উত্তর দিয়েছিলেন মোঘল সুলতনাতের শাহেনশা। বলেছিলেন, পবিত্র কোরআনে আছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা অবৈধ। আমি তো ডুবে মরেই যেতাম, তিনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তার বিনিময়ে এটুকু করাই যায়। রাত পেরোলো।
আধবেলার সম্রাট হওয়ার মেয়াদ শেষ হলো ভিস্তিওয়ালা নিজামের। প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে খুশি মনে নিজের গ্রামের দিকে রওনা হলো সে। তবে দিল্লির উপকণ্ঠ পার হতে না হতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাকাতের দল। সব ধনরত্ন লুট করে নেয় তো বটেই, প্রাণটুকুও রক্ষা পায় না। নিজামকে হত্যা করে ডাকাতরা। এই ডাকাতদল আর কেউ নয়, সম্রাট হুমায়ুনের ভাই কামরান মির্জার দেহরক্ষী বাহিনী। সিংহাসনে বসতে না পারার ক্ষোভ কামরান এইভাবেই উগরে দেন নিজামকে হত্যা করে। নিয়তির আশ্চর্য পরিহাসে আধবেলার দিল্লীশ্বরের মৃতদেহ অজ্ঞাতকুলশীল ভিখিরির মতো পড়ে থাকে রাস্তায়।
এসডব্লিউ/এসএস/২২১২
আপনার মতামত জানানঃ