বাংলাদেশে এরইমধ্যে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বাংলাদেশের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশের জনগণ, সরকার ও সুশীল সমাজকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এমনটাই বলছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, মূলত, নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ। আশা করছি, নির্বাচন কমিশন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবে। নির্বাচন কমিশন তাদের স্বাধীন সত্তা প্রয়োগ করবে। মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ছাড় দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী দেশটি মানবাধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস করবে না।
বাংলাদেশ নিয়ে গত বছর কয়েকের তুলনায় বেশ চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে বেশ তৎপরই মনে হচ্ছে। প্রতিদিনই তাগিদ দিচ্ছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের। কেবল সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নয়, সর্বজন গ্রহণযোগ্যসহ বিশেষায়িত নানা আকাঙ্খা যোগ করে চলছেন। ক’দিন ধরে বলছেন, সামনের নির্বাচন হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও কথা বলছেন সমানে। জবাবদিহি ছাড়া র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই- এমন খাসকথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পিটার হাস।
অথচ নানা ঘটনার পরিক্রমায় ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কমতে থাকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা তথা তৎপরতা। বিগত দুইজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় কেবল রুটিন ওয়ার্কে ছিলেন। কিন্তু সেই জায়গা থেকে সরে এসেছেন নতুন রাষ্ট্রদূত হাস। বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। আকাঙ্খার কথা জানাচ্ছেন। সর্বশেষ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যা দেখতে চায়, আমরা তা দেখতে চাই। সেটি হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মানের একটি নির্বাচন হবে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পরবর্তী নেতাদের বেছে নিতে পারবে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, সহিংসতাবিহীন ও দমন-নিপীড়নমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’
এখানে প্রশ্ন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ ব্যস্ততা নির্বাচনের জন্যই? আগে-পিছে অন্য কিছু নেই তো? প্রশ্নগুলো ঘুরলেও জবাব স্পষ্ট নয়। আদ্যোপান্ত জানা আরো অপেক্ষার বিষয়। ঢাকায় হাসের আগের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন। গ্লোবাল ট্যালেন্ট পরিচালকও নিযুক্ত হয়েছেন। কারো কারো কাছে এটি চিন্তার বিষয়। কিছু দুঃখজনক ঘটনা ও কথাবার্তা থাকলেও বার্নিকাট কোনো শব্দ না করে সময় শেষে ঢাকা থেকে প্রস্থান করেছেন।
কিন্তু, পিটার হাস মার্কিন এই রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে কথার কচলানি চলছে। ভারত ও চীনের দীর্ঘদিনের দ্বৈরথের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতির জের বাংলাদেশের ওপর পড়েছে অনেকের মূল্যায়ন। এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আঁচ করছেন কেউ কেউ।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা ও নীতির বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে বলে যাচ্ছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ মর্মে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক লিউ জিনসং বেইজিংয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামানকে এ বিষয়ক বার্তা দিয়েছেন। সম্প্রসারিত কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়ে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনের বিনিয়োগ শিকারের পরিণতি এবার ভোগ না করে উপায় থাকছে কিনা ঝানু কূটনীতিকরাও বুঝতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা করছে -বলছে সব একটি মহলের পক্ষে যাচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক নানা সমীকরণ লুকানো।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তার করেই চলছে। এর জেরে পরাশক্তিকেন্দ্রিক নতুন মেরুকরণের নমুনা। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে-এ নিয়ে আলোচনা বেশ সরগরম। বিশ্লেষণ নানামুখী। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর আছড়ে পড়াও স্বাভাবিক।
কোয়াডের মতো জোটে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ানোর চেষ্টা করে এখনো সুফল নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেইসঙ্গে সামরিক জোট অকাসতো আছেই। কোয়াড এবং অকাস গঠনের মূল উদ্দেশ্য চীনকে রোখা। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিষয়টি স্পর্শকাতর। বাংলাদেশকে করনীয় ঠিক করতে হচ্ছে ডান-বাম, আগ-পিছ ভেবে। কারণ, বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের বেশিরভাগই হচ্ছে চীনা অর্থায়নে। স্বাভাবিকভাবে তা চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এর মাঝেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
পরিস্থিতির এ অনিবার্যতায় বাংলাদেশকে বেশি-বেশি করে বলতে হচ্ছে- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। বিশ্ব যে অশান্তির নতুন খাদে পড়তে যাচ্ছে তা কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-রাশিয়া নয়, তা আরো অনেকের চালচলন-ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ