জলে ভাসা পদ্মের মতোই সাগর মোহনায় অসংখ্য ছোটছোট ভূখণ্ডের সমষ্টিই হচ্ছে বাংলাদেশ। পাখির দৃষ্টিতে দেখলে যত না ভূমি, তার চেয়ে বেশি জলাশয়। কিন্তু দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই দৃশ্য পট। দখল-দূষণ এবং কথিত উন্নয়নে মরে যাচ্ছে নদী। বিলীন হচ্ছে খাল-বিল-হাওর-পুকুর। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে মাটির উপরের ও নিচের জলভাণ্ডার। দখল-দূষণে কেবল নয়, নদী মরে যাচ্ছে উন্নয়নেও।
সারা দেশের নদীগুলোর ভয়াবহ দূষণের বিষয়টিও বহুল আলোচিত। দেশে বিভিন্ন নদীর পানি কতটা দূষণের শিকার, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। শিল্প-কারখানার বর্জ্য যাতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হলেও এসব ক্ষেত্রে নানা রকম অনিয়মের খবর পাওয়া যায়।
ঢাকার চারপাশ দিয়ে প্রবহমান প্রধান নদ-নদীগুলো হলো বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। এছাড়া ঢাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি খাল। খালগুলো দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নদ-নদীগুলো জৈব ও রাসায়নিক দূষণে মৃতপ্রায়। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হলে নদীদূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে।
গতকাল সিরডাপ মিলনায়তনে ‘দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকার নদ-নদী: সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নদী দূষণের সাথে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ না নেয়া হলে, নদী দূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।’
ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘কমিশনের সরেজমিন পরিদর্শনের তথ্য থেকে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি পয়ঃবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। তুরাগ নদের ২৬৯টি এবং বালু নদের ১০৪টি ও টঙ্গী খালের ৬২টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিনবর্জ্য এবং পয়ঃবর্জ্য নিঃসরিত হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক দূষণ পয়েন্ট রয়েছে।’
নদী দূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।
সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নদী, পানিদূষণবিষয়ক সব আইন আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে পাস হয়েছে। নদীর দখল দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অন্য কোনো সরকার পদক্ষেপ নেয়নি। পুরোনো মতবাদ ছিল, ‘যা নষ্ট তা পানিতে ফেলে দাও’—এ ধারণা থেকে ফিরে আসতে হবে। নদী-নালা দখলরোধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে নদী রক্ষা কমিটিকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী–নালা, খাল–বিল রক্ষা করে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন নদী রক্ষা কমিশনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। মাঠপর্যায়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিনিধি হলো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। তারা নদীর দূষণ ও দখল রোধ করে নদীর পরিবেশ রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পরামর্শ ও সক্রিয় উপস্থিতি আশা করব।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আর এক দিনও সময় নষ্ট করতে চাই না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তথ্য চাইলে সে তথ্য কেন দেওয়া হয় না, সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম অবলম্বন নদ-নদী। তবে নদী ভরাট, নব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ছোট-বড় অনেক নদী বর্তমানে বিপন্ন। মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আবাসস্থল হিসেবে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। তবে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে নদী দখল এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্য দ্বারা দূষণে নদীগুলোর যেমন বিপন্ন হয়ে পড়ছে, তেমনি নদীর পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছসহ গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ