দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আটলান্টিকে জার্মান সাবমেরিনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌবাহিনীর জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সোনার-সজ্জিত ডেস্ট্রয়ার জাহাজ। কিন্তু কেন? মূলত পানিতে শব্দের গতি প্রতিসেকেন্ডে ১,৪৯৩ মিটার। বাতাসের চেয়ে ঘনত্ব বেশি হওয়ায় জলের তলায় রাডার তরঙ্গের চেয়ে শব্দতরঙ্গই বেশি কার্যকর জলজ বস্তুর গতিবিধি শনাক্তে। এই তত্ত্ব থেকেই আবিষ্কার হয় সোনার প্রযুক্তি। আর তাতে বদলে যায় যুদ্ধের চিত্র।
বিশ্বযুদ্ধের অন্তের পর কেটে গেছে সাত দশক। এই সময়ে সোনার প্রযুক্তি হয়েছে আরও উন্নত ও শক্তিশালী। সোনার দুই ধরনের অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ। প্যাসিভ সোনার হাইড্রোফোনের সাহায্যে জলের তলায় বিভিন্ন উৎসের শব্দ রেকর্ড করে। আধুনিক কম্পিউটার ও সেন্সর সেই শব্দ থেকে কোনো বস্তুর উৎস, গতি বা আকার সম্পর্কেও একটি ধারণামূলক চিত্র দেয় নাবিকদের।
অ্যাক্টিভ সোনার নিজেই শব্দতরঙ্গ নিক্ষেপ করে। এই নিক্ষেপকে বলা হয় পালস। এটি আশেপাশের বস্তুর সাথে বাঁধা খেয়ে যে প্রতিধবনি সৃষ্টি করে তা হাইড্রোফোন রেকর্ড করে একইভাবে কম্পিউটারে আউটপুট দেয়। আধুনিক নৌবাহিনীগুলোর প্রাণস্পন্দনও তাই বলা যায় সোনারকে। যত শক্তিশালী নৌযানই হোক, সমুদ্রে সোনারহীন হলে তাদের শত্রুর হাতে ধবংসের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি।
সোনার বিশেষ করে অ্যাক্টিভ সোনারের প্রতি সামরিক শক্তির এই অতি-নির্ভরতার ফল কিন্তু ভালো হচ্ছে না সমুদ্রের প্রাণিকূলের জন্য। তিমির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য যা হয়েছে আরও প্রাণঘাতী। আটলান্টিক মহাসাগরের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে গেলেই মিলবে তার চাক্ষুষ প্রমাণ। এখানকার দ্বীপগুলোর উপকূলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেখতে পাবেন অসংখ্য তিমির কংকাল।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, সামরিক রণতরী ও ডুবোজাহাজের সোনারই তিমিদের দিকভ্রষ্ট হয়ে ডাঙ্গায় আটকে পড়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। কারণ তিমিরও আছে প্রাকৃতিক সোনার। মানবসৃষ্ট কৃত্রিম শব্দ তাদের শুনে বস্তু শনাক্তের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে আঘাত করছে তাদের মস্তিস্কে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর হাজারো তিমির মৃত্যুর জন্য এখন তাই সামরিক সোনারের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছেন পরিবেশবাদীরাও।
তবে সুখবর হলো তিমি-বিনাশী এই প্রযুক্তির দিন হয়তো ফুরিয়ে আসবে অচিরেই। অন্তত দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী নৌশক্তি- মার্কিন নৌবাহিনী নিচ্ছে এমনই উদ্যোগ।
আমেরিকার ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডার্পা) সবসময়ই নতুন ও সম্ভাবনাময় যেকোনো প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত। এবার ডার্পার বিজ্ঞানীরা তেমন আবিষ্কার নিয়েই ব্যতিব্যস্ত।
সংস্থাটির একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপক লোরি অ্যাডোরনাটো মনে করেন, খুব শিগগির আমাদের হাতে এমন প্রযুক্তি থাকবে যা দিয়ে প্রকৃতির মৃদুতর শব্দও শোনা যাবে। এতে সোনার দিয়ে শক্তিশালী শব্দতরঙ্গ নিক্ষেপের চেয়ে সহজেই শনাক্ত করা যাবে শত্রুর সাবমেরিন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, বর্তমানে সকল প্রাকৃতিক শব্দকে আমরা নেপথ্য শব্দ বা ব্যাঘাত হিসেবে ধরি। আসলে আমরা শত্রুর নৌযানের শব্দ শুনতে বেশি মনোযোগ দেই। এজন্য এসব ব্যাঘাতমূলক শব্দকে সরিয়ে ফেলি। কিন্তু, নতুন আইডিয়া হলো- কেননা আমরা এসব শব্দ শুনতেই বেশি মনোযোগ দেই। হয়তো সেভাবে শত্রুর কোনো সিগন্যালও পাওয়া যাবে।
লোরি যে প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে সেটির নাম- পার্সিসট্যান্ট অ্যাকুয়াটিক লিভিং সেন্সরস (পিএএলএস)। এই প্রকল্পের অধীনে পানির তলদেশে হুমকি শনাক্তে জলজ প্রাণীর তৈরি শব্দে কান পাতছেন ডার্পার গবেষকরা।
মহাসমুদ্রের পরিধি সুবিশাল। এত বড় এলাকায় যেখানে শত্রুর সাবমেরিনের গতিবিধি থাকতে পারে- সেখানে আকাশযান থেকে সোনার বয়া নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু, বয়াগুলির ব্যাটারির আয়ুষ্কাল সীমিত হওয়ায় মাত্র কয়েক ঘণ্টা এভাবে শব্দধারণ করা সম্ভব হয়। সে তুলনায় পিএএলএস সিস্টেম আরও বিস্তৃত অঞ্চলে একাধিক মাস ধরে সক্রিয় থাকতে পারবে।
জলার তলার প্রণালী ও উপকূলীয় অঞ্চলে শত্রু সাবমেরিনের অনধিকার প্রবেশ শনাক্তের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখাচ্ছে এ প্রযুক্তি। লোরি বলেন, এক্ষেত্রে প্রবাল প্রাচীরে যেসব প্রজাতি থাকে তারাই হতে পারে সেরা প্রহরী।
“আপনাকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে- যেন তাদের তৈরি শব্দে কান পাততে পারেন।” পিএএলএস বা পালস প্রকল্পে প্রবাল প্রাচীরের বাসিন্দা নানান প্রজাতির প্রাণীকে নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। একেকটি প্রজাতির উপর লক্ষ রাখতে রয়েছে আলাদা আলাদা টিম।
গ্রুপার মাছের শব্দে আড়িপাতা এমন একটি দল হলো- গ্রুপার গার্ড টিম। দলটির প্রধান গবেষক ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির লরেন্ট চেরুবিন। তিনি জানান, আমরা যে মাছটি নিয়ে আগ্রহী সেটি হচ্ছে বিশালাকৃতির গলিয়াথ গ্রুপার। এর ওজন ৩০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। আমেরিকার উপকূলীয় সমুদ্রে এটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়া মাছটি শিকারি প্রাণীকে ভয় দেখাতে জোরে এক ধরনের ডাক দিয়ে থাকে।
চেরুবিন বলেন, “এই শব্দ খুবই জোরালো, এবং নিম্ন-তরঙ্গের। মাছগুলি নিজস্ব এলাকায় থাকতে পছন্দ করে। তাদের এলাকায় শত্রু ঢুকে পড়লে তার উদ্দেশ্যে এই তরঙ্গাঘাত (বুম) ছুঁড়ে দেয়।”
তরঙ্গাঘাত নিক্ষেপকারী গ্রুপারকে ৮০০ মিটার দূর থেকে শনাক্ত করা যায়। তবে প্রতিটি তরঙ্গ শনাক্ত করা যায় না সহজে। শত্রুকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো ছাড়াও, প্রজননকালে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে এ ধরনের শব্দ করে গ্রুপার মাছ। তবে তারা আরও কিছু শব্দ করে- যার কারণ আজো গবেষকদের অজানা।
গ্রুপারদের বিভিন্ন রকম ডাক শনাক্তে মেশিন-লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্য নিচ্ছেন গবেষকরা। মাছটির পূর্বে ধারণকৃত শব্দের সাথে নতুন শনাক্ত ডাক মিলিয়ে দেখবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এভাবে প্রতিটি ডাকের কারণ বোঝা সম্ভব হবে বলে আশা বিজ্ঞানীদের।
তারা আশা করছেন, এই অ্যালগরিদম দিয়ে এমন সফটওয়্যার তৈরি করা যাবে যা থাকবে পানিতে স্থাপন করা যায় এমন সেন্সর বা হাইড্রোফোনের প্রসেসরে। উপকূলীয় প্রবাল প্রাচীরে থাকবে এসব হাইড্রোফোন এবং গ্রুপার মাছের শব্দে আড়ি পেতে থাকবে।
শুধু গ্রুপারের মতো বড় মাছ নয়। সমুদ্রের অপেক্ষাকৃত ছোট প্রজাতির তৈরি শব্দও যুগান্তকারী হতে পারে প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানে।
তাছাড়া, মাছের শব্দে এভাবে আড়িপাতার সাথে সামরিক কৌশলের সম্পর্ক দুর্বোধ্য ঠেকতেই পারে। কিন্তু, পালস প্রকল্পের গবেষকরা প্রতিরক্ষা কোম্পানি রেথিয়নের সাথে যে কাজটি করছেন –তা অনেকটা সাবমেরিন শনাক্তকারী সোনার সৃষ্টির সাথেই তুলনীয়। তবে এক্ষেত্রে বিশেষ কিছু অভিনবত্ব আছে।
রেথিয়নের বিজ্ঞানী অ্যালিসন লেফেরাইরা বলেন, “ডুবন্ত কোনো নৌযানের খোলে চিংড়ির শব্দ ধাক্কা খেয়ে যে প্রতিধবনি সৃষ্টি করতে পারে, আমরা তেমন সূক্ষ্ম শব্দ শনাক্তের চেষ্টা করছি। প্রচলিত সোনারও কিন্তু শব্দতরঙ্গ ছুঁড়ে দেওয়ার পর এভাবেই তা কোথায় থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে তা শনাক্ত করে।”
অর্থাৎ, এইক্ষেত্রে কৃত্রিম সোনারের মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ ছুঁড়ে না দিয়ে- নির্ভর করা হবে চিংড়ির তৈরি শব্দের ওপর। এক্ষেত্রে স্নাপিং শ্রিম্প নামের একটি প্রজাতিকে আদর্শ শব্দের উৎস বলে মনে করেছেন বিজ্ঞানীরা। পিস্তল শ্রিম্প নামেও পরিচিত এ প্রাণী এক ধরনের বাতাসের বুদবুদ তৈরি করে। এই বুদবুদ যখন ভেঙ্গে যায় তখন প্লাজমা তড়ঙ্গের সৃষ্টি হয়। এতে আলো জ্বলে এবং এমন শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি হয় যার আঘাতে প্রাণীটির শিকার অসার হয়ে পড়ে।
স্নাপিং শ্রিম্প নামকরণের আরেক কারণ- প্রাণীটি একে-অপরের সাথে যোগাযোগের সময় কাঠি ভাঙ্গার মটমট মতো আওয়াজও করে। অ্যালিসন জানান, এ প্রজাতির একদল চিংড়ি যে আওয়াজ করে- তা একসাথে শুনে মনে হবে তাওয়ায় চর্বি ভাজা হচ্ছে।
“তাদের তৈরি শব্দ ক্ষণস্থায়ী হলেও তা বিস্ময়কর রকম দীর্ঘ তরঙ্গের। প্রচলিত সোনারের চেয়ে একটি চিংড়ির শব্দ বেশ ক্ষীণ হলেও, হাজার হাজার এ প্রাণীর শব্দ প্রতিমিনিটে হাজারের বেশি প্রতিধবনি সৃষ্টি করে।”
তিনি জানান, পানির তাপমাত্রা ভেদে দিনে ও রাতে শব্দ তৈরির মধ্যে কিছুটা কমবেশি হয়। তবে এ ধরনের চিংড়ির কলোনি কখনোই নিঃশব্দ থাকে না।
অ্যালিসন জানান, চিংড়িগুলো অনেক বেশি শব্দ করে। আর সেগুলি চারপাশে ধাক্কা খেয়ে যে প্রতিধবনি তৈরি করে তাতে ব্যাপক শোরগোল শোনা যায় আমাদের হাউড্রোফোনে। এই শোরগোল আলাদা করাটাই আপাতত আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অ্যালিসন আশা করছেন, প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে এক সময় সহজেই তা করা যাবে। এতে করে ব্যবহার কমবে কৃত্রিম সোনারের। ফলে আমেরিকার উপকূলীয় সমুদ্র এলাকায় তিমি ও ডলফিনের মতো জলজ প্রাণীদের বিচরণ হবে নিরাপদ ও বাধামুক্ত। একেবারেই অভিনব হওয়ায় চীন ও রাশিয়ার মতো বৈরি দেশের সাবমেরিনের গতিবিধি মনিটর করাও সহজ হবে।
এভাবেই মার্কিন বিজ্ঞানীরা চিংড়ি, গ্রুপারসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর তৈরি শক্তিশালী শব্দের প্রতিধ্বনিকে শোনার মাধ্যমে শত্রু সাবমেরিনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে চাইছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ