মার্কিন প্রধান জলবায়ু সংস্থা শুক্রবার বলেছে, গত মে মাসে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশী ছিল। যা পৃথিবীতে গত ৪০ লাখ বছরের মধ্যে দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফিরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) বলেছে, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, সিমেন্ট উৎপাদন অথবা বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব এই নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সাধারণত প্রতি বছর মে মাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পায়।
২০২২ সালের মে মাসে বায়ুমণ্ডলে এক ইউনিট পরিমাপে বায়ুদূষণের পরিমাণ ৪২০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) বা মিলিগ্রাম পার লিটার (এমজি/এল) ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালের মে মাসে এই হার ছিল ৪১৯ পিপিএম এবং ২০২০ সালে ছিল ৪১৭ পিপিএম।
হাওয়াইয়ের মাওনা লোয়া মানমন্দির বায়ুমণ্ডলের এই দূষণের পরিমাপ করেছে। এই মানমন্দির একটি আগ্নেয়গিরি পর্বত চূড়ায় অবস্থিত, যা স্থানীয় দূষণের প্রভাব থেকে প্রকৃত দূষণ মাত্রা আলাদা করতে পারে।
এনওএএ জানায়, বিপ্লবের আগে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা প্রায় ২৮০ পিপিএম-এ স্থির ছিল, যা মানব সভ্যতার প্রায় প্রায় ৬ হাজার বছর বা প্রাক-শিল্পযুগ পর্যন্ত স্থির ছিল। বর্তমান স্তর ৪১ থেকে ৪৫ লাখ বছর আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। তখন কার্বন ডাই অক্সাইডের এই মাত্রা ৪০০ পিপিএম-এর কাছাকাছি বা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এর প্রভাব অপরিসীম। ১৩০০ থেকে ১,৬০,০০০ বছর আগে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে ১৮০ থেকে ২০০ ভাগ (Parts per million-PPM)। ১,১৬,০০০ থেকে ১,৪০,০০০ বছর আগে তা বেড়ে ২৭০ PPM হয়ে যায়। কিন্তু উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর শিল্প ও যানবাহন বিপ্লবের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং ১৯৫৮ ও ১৯৯০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫ এবং ৩৫৫ PPM।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৭০ PPM থাকা পর্যন্ত মানুষের স্বস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে থাকে। অক্সিজেনের পরিমাণ ≤ ১৬% হলে প্রবল শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যদি অক্সিজেনের পরিমাণ ≤ ৮% পর্যন্ত কমে যায় তখন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে এবং তার মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। সমাজভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাতাসে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের শরীরে নানা রকম ক্ষতিকারক প্রভাব দেখা দেয়।
উচ্চমাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইড মস্তিষ্কের রক্তনালী প্রসারিত করে। এতে মস্তিষ্কে রক্তের চাপ বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। শিশুদের রক্তনালী প্রসারিত হয়ে যায় এবং তার শরীর থেকে দ্রুত উত্তাপ নির্গত হয়ে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয় (panic attack) উচ্চমাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুস এবং শরীরের রক্তনালীর রক্তচাপ বেড়ে যায় (pulmonary pressure and systemic hypertension)।
কার্বন নিঃসরণে কমানোর জন্য যদিও পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলোই বার বার একত্রিত হয়েছে, তথাপি দীর্ঘ সময় ধরে নানা রকম বাগবিতণ্ডার মধ্য দিয়েই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছিল- যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাবে। আর আন্তর্জাতিক সহয়তা পেলে কমাবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন রকম। জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে বাগবিতণ্ডা এতটাই সময়ক্ষেপণ করেছে যে, ২০১৫ সালের ‘অমিশন গ্যাপ’ সভায় এ কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিশ্বের ১১৯টি দেশ কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলেও অতিরিক্ত কালক্ষেপণের কারণে এর পরও পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে।
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন ২৩-৪৩ শতাংশ। এর পর যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ এবং তৃতীয় ভারত ৫ শতাংশ।
কার্বন নিঃসরণের ফলে তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি বেড়ে যায় তবে ৩০-৪০ শতাংশ প্রজাতিকুলের বিলুপ্তি ঘটবে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় খরা-বন্যা, সাইক্লোনের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহচ্যুত ও দেশচ্যুত হয়েছে। কোপেনহেগেনে ১৯৯০ সালে গ্রিন কার্বন গ্যাসের পরিমাণ যা ছিল সেই পর্যায়ে ফিরে যেতে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ২০% গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনার কথা হলেও ২০২১ সালেও এর কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলো Industry, Civilization, Growth and Development ইত্যাদির ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে একই সঙ্গে গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনার যে সমস্ত কথা বলেছেন তার অন্তরালে মুনাফা-লিপ্সাই প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে পৃথিবীর ধ্বংস ত্বারান্বিত হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার বলেই মনে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ