সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনার-কিলিং হল কাউকে নিজের পরিবার বা গোত্রের সম্মানহানির দায়ে ঐ পরিবার বা গোত্রের কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি, যাকে সম্মানহানির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা। যার মাধ্যমে বংশের মর্যাদা এবং ধর্মীয় সম্মান রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। এই হত্যার মাধ্যমে হত্যাকারীদের বংশের মর্যাদা এবং ধর্মীয় সম্মানহানির উপযুক্ত প্রতিকার হয়েছে বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অনার কিলিং প্রচলিত। নারীরা হলো অনার কিলিং এর প্রধান শিকার।
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচের ভেলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে পাকিস্তানের সোশাল মিডিয়া তারকা কান্দিল বালুচকে হত্যা করে তার ভাই মুহাম্মদ ওয়াসিম৷ ২০১৯ সালে ওয়াসিমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আইনের ফাঁক গলিয়ে এই ফেব্রুয়ারিতে তিনি মুক্তি পেয়ে গেছেন৷
ফেসবুকে ছোট স্কার্ট পরে নাচের ভিডিও আপলোড করে আলোচিত হয়েছিলেন কান্দিল বালুচ৷ এসব কারণে পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে ধরে নিয়ে কান্দিলকে মেরে ফেলা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল বলে সেই সময় পুলিশকে জানিয়েছিলেন ওয়াসিম৷
ঐ হত্যাকাণ্ডের পর সমালোচনার ঝড় উঠলে সরকার অনার কিলিং আইনে কিছু পরিবর্তন এনেছিল৷ যেমন হতাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবার আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমা করতে পারবেন না৷ এছাড়া আদালতে বাইরে ‘ব্লাড মানি’ দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করা যাবে না ইত্যাদি৷
কিন্তু যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার পর ওয়াসিমের আইনজীবীরা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে ওয়াসিমের ক্ষেত্রে ঐ আইনের পরিবর্তনগুলো প্রযোজ্য হবে না৷ সে কারণে ওয়াসিমের মা তাকে ক্ষমা করে দিলে এই ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান তিনি৷
কান্দিল বালুচের এই ঘটনা এটিই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্থা এমন যে, পুরুষরা নারীদের হত্যা ও ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যান৷
অধিকারকর্মী নায়েব গোহর জান এএফপিকে বলেন, ‘পাকিস্তানে নারীর প্রতি অপরাধের শুরু থেকে পুলিশের কাছে মামলা করতে যাওয়া, এরপর বিচার প্রক্রিয়া— সবকিছু এমনভাবে সাজানো যে বিচার অধরাই থেকে যায়’৷
আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বিচার ব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত নারী আইনজীবী ও বিচারকের অভাবের কারণে অনার কিলিংয়ের রায়গুলো পালটে যাচ্ছে৷
পাকিস্তানের আদালতগুলোতে নারী বিচারকের সংখ্যা পুরুষদের এক পঞ্চমাংশেরও কম৷
পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে নারী ভুক্তভোগীরা সাধারণত বিচারের সুযোগ পান না৷ কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় মুরুব্বিরা (সবসময় পুরুষ হয়ে থাকে) সালিশ করে থাকেন৷ তারা সাধারণত নারীর প্রতি সহিংসতাকে ‘সম্মান’ রক্ষার উপায় হিসেবে দেখে থাকেন৷
এই প্রক্রিয়ায় দ্রুত বিচার হওয়ায় অনেকে এটি সমর্থন করেন৷ কিন্তু সেখানে সাধারণত আপিলের সুযোগ থাকে না৷
নারীরা একদিকে তো বিচার পায় না, অন্যদিকে ভুক্তভোগী তাদের দোষী বানানোর চেষ্টা করা হয়।
খাদিজা সিদ্দিকিকে তার সাবেক ছেলেবন্ধু ২৩ বার ছুরিকাঘাত করে মৃত মনে করে ফেলে রেখে গিয়েছিল৷ এরপর তার বন্ধুটিকে হত্যা চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়৷ কিন্তু আপিল করে সে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল৷ পরে আবারও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়৷ পরে ভালো আচরণের যুক্তি দেখিয়ে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছেড়ে দেয়া হয়েছে৷
পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্থা এমন যে, পুরুষরা নারীদের হত্যা ও ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যান৷
সিদ্দিকির ঘটনায় তাকেই দোষী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে আইনজীবীর বলছেন৷
ভুক্তভোগীকে দোষ দেয়ার এমন ঘটনা পাকিস্তানে সাধারণ একটি বিষয়৷ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নারীর প্রতি সহিংতার জন্য মেয়েদের ‘খুব সামান্য পোশাক পরাকে’ প্রায়সময় দায়ী করতেন৷ ২০২০ সালে একটি রাজ্যের পুলিশ প্রধান গণধর্ষণের শিকার এক নারী রাতে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া গাড়ি চালাতে বের হওয়ায় তাকে ভর্ৎসনা করেন৷
নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে দেশটিতে৷ দেশটির অধিকাংশরাই মনে করেন নারীরা অনিরাপদ।
সম্প্রতি করাচিভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পালস কনসালট্যান্ট এক জরিপে জানিয়েছে, দেশটির ৩৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন পাকিস্তানি কোনো নারীই নিরাপদ নন। ৪৩ শতাংশের মতে, কিছু দিক থেকে নারীরা নিরাপদ। ২০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীরা নিরাপদ পাকিস্তানে।
পাকিস্তানিদের মধ্যে যারা মনে করেন দেশটির নারীরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ, তাদের বেশির ভাগ খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বাসিন্দা। প্রদেশটি থেকে জরিপে অংশ নেওয়া ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে নারীদের অনিরাপদ বলেছেন।
পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে৷ কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে সাম্প্রতিক কিছু নারী হত্যার ঘটনা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে৷
২৫ জুলাই সিন্ধ প্রদেশে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে৷ একই দিনে শিকারপুর শহরে আরেক ব্যক্তি তার স্ত্রী, খালা এবং নিজের দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে৷ রাওয়ালপিন্ডিতে এক ৩০ বছর বয়সি নারীকে ধর্ষণের পর ছুরির আঘাত করা হয়৷ পরে তিনিও মারা যান৷
১৮ জুলাই সিন্ধ প্রদেশে এক স্বামী তার স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন৷ এর আগের মাসে পেশাওয়ারে এক ব্যক্তি তার সাবেক স্ত্রীসহ দুজনকে ‘সম্মানরক্ষার’ নামে হত্যা করে৷
অধিকারকর্মীরা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন৷
বেলুচিস্তানের সাবেক আইনপ্রণেতা ইয়াসমিন লাহিড়ি বলেন, এক নারী আইনজীবীকে ছুরি দিয়ে ১২ বার আঘাত করার পরও আদালত এক ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন৷ নারীর প্রতি যারা সহিংসতা করে, তাদের কী বার্তা দেয়া হলো এর মাধ্যমে?
২০০২ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া অধিকারকর্মী মুখতার মাই-এর মতও একই৷ তিনি বলেন, যারা নারীর প্রতি সহিংসতা করে, তারা আইনি প্রক্রিয়াকে ভয় করে না৷
তিনি জানান, বেশিরভাগ পাকিস্তানি পুরুষ নারীকে পেটানোকে কোনো সহিংসতাই মনে করে না৷ পাকিস্তানি সমাজ এখনও সামন্তবাদী এবং গোত্রবাদী প্রথা থেকে বের হতে পারেনি বলেও মনে করেন তিনি৷
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে৷ লাহোর-ভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলনকারী মাহনাজ রেহমান বলেন, যখনই নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় তখনই তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয়৷
তিনি বলেন, নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় পুরুষকে মান্য করে চলার জন্য, কারণ, পরিবারে তাদের স্ট্যাটাস উঁচুতে৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মান রক্ষার্থে খুন— অনার কিলিং। শব্দগুলো আর নতুন করে স্তম্ভিত করে দেয় না। মেয়েরা এখন এই শব্দগুলো শুধু নয়, এই মৃত্যুগুলোর সঙ্গেও পরিচিত। অনেক বছর হয়ে গেল এই নৃশংসতার, তাই মেয়েরাও বোধহয় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারাও জেনে গেছে যে যেকোনও সময়ে পরিবার, সমাজ সব জায়গা থেকে বীভৎসতম আঘাতটা তারা পেতে পারে। যত বড় চাকরিই করুক বা যত সহজ-সাধাসিধে একটা জীবনের স্বপ্নই দেখুক না কেন, জীবনটা যখনই নিজের হাতে নিতে চান, যেমনই হোক একটা নিজস্ব যাপনের চিন্তা করেন, তখনই মেয়েদের জীবনটাই একটা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া সবই যেন অন্যের উপর নির্ভরশীল— বিশেষত পরিবারের পুরুষদের। অবশ্য মানসিকতাটা যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, সেখানে পুরুষ, নারী নির্বিশেষে যে কেউই এই নির্যাতনে, এই হত্যায় শামিল হয়ে যান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১২
আপনার মতামত জানানঃ