দেশ থেকে যে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়, এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে তা স্বীকারই করা হচ্ছিল না। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে সরকারই এখন পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার পথ খুঁজতে শুরু করেছে।
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে ৯ জুন। এ বাজেটের আগেই সরকার এ বিষয়ে নতুন ঘোষণা দিতে পারে বলে জানা গেছে।
মূলত বিদেশ থেকে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে চায় সরকার। এ জন্য আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ যেসব বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন, নামমাত্র কর দিয়ে সেগুলো দেশে ফিরিয়ে আনাই সরকারের উদ্দেশ্য।
বিদেশে টাকা পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী বাজেটে ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বৃহস্পতিবার (২৬ মে) দুপুরে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স নিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ মিলছে, এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘এটি আপনারা বাজেটে পাবেন, বাজেটে এটা থাকবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যেটি করছে, সেটি বাজেটের আগেই করছে।’
যারা টাকা পাচার করেছে, তারা ট্যাক্স দিয়ে রেকর্ডে নাম লেখাতে চাইবেন কি না, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে তো এ সুযোগ অনেকে নিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়া যখন এমন একটি অ্যামনেস্টি ঘোষণা করলো, তখন অনেক টাকা বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এখান থেকে যারা টাকা নিয়ে গেছেন, এ সুযোগটি তাদের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি সুযোগ, সেটি তারা কাজে লাগাবেন। সব দিক থেকে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’
বিদেশ থেকে পাঁচ হাজারের বেশি ডলার পাঠানোর ক্ষেত্রেও কোনো ডকুমেন্টস লাগবে না, এতে বিদেশ থেকে কালোটাকা আসবে কি না এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইছি, বিভিন্ন সময়ে যেসব কালোটাকা বিদেশে থেকে গেছে, বিভিন্ন সোর্স থেকে সেটি জানতে পারি। অনেক সময় বলা হয়, বিদেশে যারা টাকা নিয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? বিদেশে যে টাকা চলে গেছে, আমরা বলেছি যাতে টাকাগুলো দেশে ফেরত আসে।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বাজেটের আগেই আমরা এটা করার চেষ্টা করছি। নিজেরাও চিন্তা-ভাবনা করছি। এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেটি আমরা জানি। সংসদে বাজেট উত্থাপিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে বলতে চাই না। যখন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার ইস্যু করবে, তার মাধ্যমেই আপনারা জানতে পারবেন।’
‘যেসব টাকা বিভিন্ন চ্যানেলে চলে গেছে, সেগুলো ফেরত আনার জন্য এ উদ্যোগ। এ ধরনের অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) বিভিন্ন দেশ দিয়ে থাকে। তবে কত টাকা গেছে, সেটির ধারণা দিতে পারবো না।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘যেসব টাকা বিভিন্ন চ্যানেলে চলে গেছে, সেগুলো ফেরত আনার জন্য এ উদ্যোগ। এ ধরনের অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) বিভিন্ন দেশ দিয়ে থাকে। তবে কত টাকা গেছে, সেটির ধারণা দিতে পারবো না।’
ডলার সংকটের জন্য এ সিদ্ধান্ত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই ডলার ক্রাইসিসের জন্য। ডলার আমাদের দরকার। তবে যে ক্রাইসিস বুঝিয়েছে সেটি নেই, আমাদের ফরেন রিজার্ভ ভালো। এখনো ফরেন রিজার্ভে আশেপাশের দেশের তুলনায় আমরা অনেক স্বাভাবিক অবস্থায় আছি। এ ধরনের ক্রাইসিস আমরা আগেও লক্ষ্য করেছি। ২০০১ সালে সেটি আমরা দেখেছি।
জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, স্পেন, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ যেভাবে তাদের দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কৌশল অবলম্বন করছে, বাংলাদেশও সে পথে এগোচ্ছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে বলে জানা গেছে।
পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার একটি কৌশল হচ্ছে সম্পদ বিদেশে রেখেই তাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা। এটি হচ্ছে বাড়ি-গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে। অন্যটি হচ্ছে নগদ অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। বিদেশে ইতিমধ্যে যারা সম্পদ গড়েছেন, আয়কর রিটার্নে তারা তা দেখাতে পারবেন। এ জন্য তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তবে কর দিতে হবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, কর ছাড় দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের যে উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, তা নৈতিক বিবেচনায় ঠিক নয়। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন বলে আশঙ্কা হয়।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থার এই সময়ে আমাদের আগামী বাজেটটি খুবই কৌশলের সঙ্গে করতে হবে জানিয়ে তারা বলেন, চূড়ান্ত বিচারে বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হলে করব্যবস্থায় সংস্কার আনা জরুরি। অন্যথায় কর ফাঁকি দিয়ে মানুষ বিদেশে অর্থ পাচার করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ