বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করতে হলে দুটি বিষয় আমাদের মাথায় আসে— একটি হলো উৎসব, অন্যটি সহিংসতা। নির্বাচন নিয়ে অতীত স্মৃতি আমাদের যতটা আনন্দের, তার চেয়ে বেশি ভয়ের। এই ভয় হলো নির্বাচনী সহিংসতা। দেশে নির্বাচনী সহিংসতা যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের বিগত প্রায় সব জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র ফুটে ওঠে। এ নির্বাচনী সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৭৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে, আর সীমান্তে সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন চারজন।
৯টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও আসক-এর নিজস্ব সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে নারী শিশু নির্যাতন, সীমান্ত সংঘাত, রাজনৈতিক সংঘাত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
আসক বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৪০ জন নারী। এর মধ্যে ৬০ জন স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। প্রথম চার মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩১৭ জন নারী। ১৮ জনের ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে, আর ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনজন।
চলতি বছর প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ১৭৬টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ১৭৬টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে মাত্র ৮০টি। হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৩৭টির বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। আর ৪৭টির বয়স ৬ বছরেরও কম। এ সময় সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৬৬টি শিশু।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সহিংসতা দূর করতে নির্বাচন কমিশন কঠোর হচ্ছে না কেন? নির্বাচনের সময় যেহেতু স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে চলে তাই এই পরিস্থিতির দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার ওপর। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য আমাদের নির্বাচনী সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য নির্বাচনী সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৭
আপনার মতামত জানানঃ