ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন- ইন্টারনেট সংশ্নিষ্ট সব সেবাই আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের ট্র্যাকিংয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
ইন্টারনেট বিশ্বে প্রত্যেক ব্যবহারকারীই যেন পণ্য! ইন্টারনেটে ব্যবহারকারী কী খোঁজেন, কোথায় যান, কী করেন এরকম হরেক তথ্য সংগ্রহ করে সেবাদাতা কোম্পানিগুলো। ডিজিটাল বাণিজ্যের স্বার্থে ব্যবহারকারীর এসব ব্যক্তিগত তথ্য দিনে শত শতবার হাতবদল হয়।
সম্প্রতি এ সত্যটি আবারও সামনে এনেছে আইরিশ কাউন্সিল ফর সিভিল লিবার্টিস (আইসিসিএল) নামে অলাভজনক সংস্থা।
সংস্থাটির বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৭৪৭ বার হাতবদল হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের জন্য এটি ৩৭৬ বার।
বিবিসি জানিয়েছে, বর্তমানে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন শিল্প এবং ‘ডেটা প্রোটেকশন কমিশন’-এর সঙ্গে আইনি লড়াই চলছে আইসিসিএল-এর। বিজ্ঞাপনী খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যবহারকারীদের ডেটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শেয়ার করার বিরোধীতা করে আসছে অলাভজনক সংস্থাটি। ব্যবহারকারীরা এই লাগামহীন ডেটা শেয়ারের অনুমতি দেয় না বলে অভিযোগ তাদের।
বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের পক্ষে কাজ করা মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে চলে ব্যবহারকারীদের ডেটা আদান-প্রদান, ওয়েবপেইজে তাৎক্ষণিকভাবে ডেটা আপডেট হতে থাকে। বিজ্ঞাপনদাতা ব্র্যান্ডগুলো এক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত থাকে না।
কোন ডিভাইসে ওয়েবপেইজ লোড হচ্ছে, ডিভাইসটির অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য এবং ব্যবহারকারী আগে একই বিষয়ের কোন কোন ওয়েবসাইটে গেছেন সে তথ্যও যায় বিজ্ঞাপনদাতাদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারীদের কাছে।
ওয়েবপেইজে জায়গা বিজ্ঞাপনের জন্য বিক্রি করার বেলায় কাজে আসে তথ্যগুলো। সর্বোচ্চ দাম হাকানো বিজ্ঞাপনদাতা পাওয়া সহজ হয়। আর এ সবই হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেকেন্ডেরও কম সময়ে।
জনপ্রিয় ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বিনামূল্যে ব্যবহার করা গেলেও এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীদের তথ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে লাগামহীনভাবে শেয়ার করে থাকে।
আইসিসিএলের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. জনি রায়ান বলেন, কোন ডিভাইসে ওয়েবপেজ লোড হচ্ছে, ডিভাইসটির অবস্থান কোথায় এবং ব্যবহারকারী আগে একই বিষয়ের কোন কোন ওয়েবসাইটে গেছেন, এসব তথ্যও হাতবদল হয়। ওয়েবপেজে বিজ্ঞাপনের চাহিদা তৈরি এবং দাম নির্ধারণে এসব তথ্য কাজে লাগে।
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ঘটা এ ঘটনাকে তিনি ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডাটা ফাঁস’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
কোন ডিভাইসে ওয়েবপেজ লোড হচ্ছে, ডিভাইসটির অবস্থান কোথায় এবং ব্যবহারকারী আগে একই বিষয়ের কোন কোন ওয়েবসাইটে গেছেন, এসব তথ্যও হাতবদল হয়। ওয়েবপেজে বিজ্ঞাপনের চাহিদা তৈরি এবং দাম নির্ধারণে এসব তথ্য কাজে লাগে।
ইন্টারনেট থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মূল কোম্পানি), অ্যালফাবেট (গুগল ও ইউটিউবের মূল কোম্পানি) অন্যতম। ২০২১ সালে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন থেকে অ্যালফাবেটের আয় প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলার এবং মেটার আয় ১১৪ বিলিয়ন ডলার। এ সময় মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম টুইটারও চার বিলিয়নেরও বেশি আয় করেছে। অবশ্য জরিপটি পরিচালনায় শুধু গুগলের ডাটা নিয়ে কাজ করেছে সংস্থাটি।
মূলত বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত ডাটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শেয়ার করার বিরোধিতা করে আসছে অলাভজনক সংস্থা আইসিসিএল। এ লক্ষ্যে ‘ডাটা প্রটেকশন কমিশন’-এর সঙ্গে আইনি লড়াইও চালাচ্ছে সংস্থাটি।
বিবিসি জানাচ্ছে, ব্যবহারকারীরা তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য জেনেশুনে এভাবে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে শেয়ারের অনুমতি না দিলেও এটিই করে আসছে সেবাদাতারা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল।
অনলাইন বিশ্বে কেনাকাটা থেকে শুরু করে যে কোনো সেবা গ্রহণে ব্যক্তিগত নানা তথ্য দিতে হয় গ্রাহকদের। এসব তথ্যের নিরাপত্তা ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলে আর্থিকসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন গ্রাহক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তেই আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে থাকতে একরকম বাধ্য হচ্ছি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আপনি গুগলে কোনো খাবার হোটেল কিংবা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য সার্চ করেছেন। এরপর ফেসবুক ঢোকার পরেই দেখলেন, ফেসবুক ওই সংশ্নিষ্ট পণ্যের বিজ্ঞাপন আপনার ওয়ালে প্রদর্শন করতে শুরু করেছে!
বিষয়টি কতটা ভয়ংকর দেখেন, চান বা না চান; গুগলে আপনি কী করেছেন তা জেনে নিচ্ছে ফেসবুক! ব্যবসা নিয়ে গুগল ফেসবুকের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আপনাকে দিয়ে ব্যবসার অর্থ ভাগাভাগিতে কতটা উদার তারা! এভাবেই অনলাইনে প্রতিনিয়ত আমাদের সকল গোপনীয়তা সকল ডাটা শেয়ার হচ্ছে। কে কখন কীভাবে আমার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে তার হদিসও হয়ত আমরা জানি না। এরই প্রেক্ষাপটে কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ভালোভাবে নিরাপদে রাখা যায়, তা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৯
আপনার মতামত জানানঃ