বর্তমানে দেশের মোট ঋণ ১৫৬ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে)। এই অর্থ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ।
গত কয়েক বছরে এটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। যদিও ঋণ পরিশোধে আপাতত স্বস্তিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০২৪-২৫ সালের পর হলুদ জোনে (অস্বস্তিতে) পড়বে।
সোমবার এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।
তার মতে, বর্তমানে ঋণ বৃদ্ধির হার জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। আর নির্বাচনি বছরে ঋণ বাড়ে। সাধারণত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঘাটতি থাকলে ঋণের অর্থ দিয়ে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নিয়ে, তা পূরণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ ধরনের প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির আরেকজন বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, বর্তমানে দেশের মোট ঋণের স্থিতি ১৫৬ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বিদেশ থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ ৬৯ দশমিক ০৪ বিলিয়ন, বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন এবং বিদেশ থেকে শর্তসাপেক্ষে ঋণ (সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট ও অন্যান্য) ৮ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেন, সরকার যে দায়-দেনার হিসাব করে, সেখানে শুধু সরাসরি সরকারের নেওয়া বিদেশি ঋণ ধরা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণ, বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ এবং শর্তসাপেক্ষে ঋণ হিসাবে নেওয়া হয় না। এটি সঠিক নয়। কারণ সরকারের দায়দেনা বলতে সবকিছু বোঝাবে। এর কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারকেই দায় নিতে হবে।
তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ বাড়ছে। গত তিন বছরে গড়ে ৭ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ বেড়েছে। কিন্তু প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার অনুদান পাইপলাইনে রয়েছে। সক্ষমতা ও সংস্কারের অভাবে সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
এসডিজিবিষয়ক নাগরিক প্ল্যাটফরমের এই আহ্বায়ক বলেন, দায়দেনার কারণে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে-এমন কয়েকটি দেশ হলো গ্রিস, ঘানা, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপাল। মূলত তিনটি কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে না পারা, বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনের ভারসাম্যে দুর্বলতা এবং অপরিকল্পিতভাবে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া। তার মতে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণ একেবারে কম।
কারণ ১৭ কোটি মানুষের দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে ৭৩ লাখ। এর মধ্যে ২৩ লাখ মানুষ আয়কর দেয়। আর মোট কর আদায় জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যা সবচেয়ে কম।
ফলে এখানে অনেক বেশি নজর দিতে হবে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে কারেন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক। রেমিট্যান্স এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমছে। এটি উদ্বেগজনক।
তিনি বলেন, কোনো দেশে দায়দেনা বাড়লে ৭টি সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে, মুদ্রার মান কমে, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে এবং নিম্নমুখী হবে ক্রেডিট রেটিং।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে কোনো দেশের দায়দেনা জিডিপির ৭৭ শতাংশের ওপরে গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। তবে একক কোনো সূচক দিয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা মূল্যায়ন করা যায় না। ফলে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তার মতে, রাষ্ট্রীয় এক প্রতিষ্ঠানের কাছে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে। সাধারণত এগুলো দায়দেনার হিসাবে আনা হয় না। উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বলেছে, তারা বাংলাদেশ বিমানের কাছে ২শ কোটি টাকা পাবে। এই টাকা পরিশোধ না করলে ভবিষ্যতে তাদের কোনো সহায়তা দেবে না।
সিপিডির বিশেষ ফেলো বলেন, পরিসংখ্যান বলছে, নির্বাচনের বছর সরকারের দায়দেনা বাড়ে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকলে বিভিন্ন দেশের সরকার ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্প মানুষকে দেখিয়ে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রকল্প যৌক্তিক নয়।
শ্রীলংকাসহ সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন দেশে এই চিত্র দেখা গেছে। গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতও সরাসরি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে। বর্তমানে এই ঋণের স্থিতি ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের দায় সরকারের। কোনো কারণে তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে শর্তসাপেক্ষে যেসব ঋণ রয়েছে সেগুলো হিসাবে আসে না। যেমন, বাংলাদেশে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলা হলেও সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট হিসাবে চীন থেকে ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার নেওয়া হয়েছে। এই ঋণের মেয়াদ ১৫ বছর। এক্ষেত্রে গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর।
অর্থাৎ প্রথম ৫ বছরে কোনো সুদ ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। তবে এই ৫ বছর ইতোমধ্যে শেষ হতে চলেছে। এছাড়াও মেগা প্রকল্পে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে দ্বিপাক্ষিক ঋণ গ্রহণ বাড়ছে। এই দ্বিপাক্ষিক ঋণের সুদ অত্যন্ত বেশি।
এছাড়াও বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে কিছু ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়া থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার, ভারত থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন, জাপান থেকে ১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে ভারত থেকে নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর এবং রাশিয়া ও জাপান থেকে নেওয়া ঋণে ১০ বছর। অর্থাৎ শিগগিরই কিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। সবকিছু মিলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়ছে, এর চেয়ে জাতীয় দায়দেনার হার বেশি।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমানে এগুলো অটো-পাইলটের মতো (চালকবিহীনভাবে) চলছে। এক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা এবং সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে দেশীয় উৎস থেকে দায়দেনা বেশি বাড়ছে। কিন্তু বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে।
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা করা যৌক্তিক নয়। তবে শ্রীলংকার ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ