বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে। গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
কোনো অপরাধকর্মের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও পুলিশি হয়রানির মুখে পড়া যেন এখন দেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অনেক সময় চাঁদাবাজি করা বা টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে এসব করা হয়। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এলাকার তিন থানার ছয় পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। চাহিদামতো টাকা না পেয়ে তারা কাউকে মাদক, আবার কাউকে মানব পাচারের মামলায় জড়িয়েছেন।
ওই পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ভাড়ায় চলা মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রী।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রূপনগর, পল্লবী ও দারুস সালাম থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি করে না পাওয়ায় মামলা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ এনেছেন পাঁচ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ভাড়ায় চলা মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রী।
গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশের মিরপুর বিভাগ। উল্টো পুলিশ সদস্যদের কাছে থেকে চাঁদা না পেয়ে এমন অভিযোগ করা হয়েছে বলে দাবি করে তারা।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তথ্যদাতা (সোর্স) ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে চাঁদা আদায় করছে। রাজধানীর রূপনগর টিনশেড এলাকার বাসিন্দা রাশিদা আক্তারের রিকশার ব্যবসা আছে। তার সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনা নিয়ে তিনি আইজিপি, ডিএমপির কমিশনার ও মিরপুর বিভাগের ডিসির কাছে আবেদন করেছিলেন।
রাশিদা প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যানসারে ভুগছেন। গত বছরের ১৯ আগস্ট রাতে রূপনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান বাসায় ঢুকে চোরাই মুঠোফোন থাকার অভিযোগ তোলেন। তিনি এটি অস্বীকার করলে মাসুদুর পুরো বাসায় তল্লাশি চালিয়েও কিছু পাননি। একপর্যায়ে মাসুদুর তার ব্যাগ থেকে জোর করে চাবি নিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে সেখান থেকে আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান। মাসুদুর তার সোর্স সোহাগ ও অপুর যোগসাজশে এ টাকা লুট করেন।
পুলিশ তথ্যদাতা (সোর্স) ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে চাঁদা আদায় করছে।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে উল্টো সেই নারীর বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা দেওয়া হয়। রূপনগরের আরও একটি ঘটনায় ইয়াবা আছে বলে তল্লাশি করে গাঁজা রাখার অভিযোগে মামলা করে পুলিশ। সেই ঘটনায় ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেলেও পুনরায় মিথ্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ দুই ঘটনাতেই অভিযোগ উঠেছে রূপনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে।
পল্লবী থানায় তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে না পাওয়ায় এক ব্যক্তিকে পুলিশ মাদক (হেরোইন) মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মুঠোফোন মেরামতের দোকান চালানো ওই ব্যক্তির পরিবার এখন দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। দারুস সালামে একইভাবে মাদকের মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে দুই ব্যক্তিকে। স্বজনেরা টাকা দিলেও মামলা থেকে রেহাই পাননি তারা।
এদিকে রাঙামাটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইনচার্জ ও এসআইয়ের বিরুদ্ধে টাকা না দেওয়ায় আসামি করার অভিযোগ করেছেন এক দম্পতি। সোমবার (১৬ মে) সকালে শহরের কলেজগেট এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ তোলেন রুবি বেগম ও তার স্বামী মাহবুব আলম।
লিখিত বক্তব্যে রুবি বেগম বলেন, আমার প্রথম সংসারের ছেলে ইনিছুল হক শামীমকে গত ১৪ মে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আটক করে। পরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের ইনচার্জ শিবনাথ কুমার সাহা ও এসআই লিটন নন্দী আমার থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুস দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় পরে আমার স্বামীকে মামলায় দুই নম্বর আসামি করে।
শিবনাথ কুমার সাহা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আসামি শামীম জিজ্ঞাসাবাদে মাহবুবের নাম বলেছেন। এর আগেও মাহবুবের নামে মামলা রয়েছে।
পুলিশের চাঁদাবাজির বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মাদক। এসব ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগও আছে। রাস্তায় পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়া এখন রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ সময় ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে সম্মানহানি ও পুলিশি হয়রানির কারণে চুপ মেরে যান।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন নিরপরাধ মানুষ ঘর থেকে কাজে বের হয়ে আচমকা পুলিশের সামনে পড়ে অপরাধী হয়ে যাবে, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মামলার হাজিরা ও দিনের পর দিন আদালতে দৌড়াতে গিয়ে সময় ও অর্থ ব্যয়ে জর্জরিত হতে হয় তাদের। এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা, দায়মুক্তি পাওয়াটাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। আমরা এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশি কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলদের আরও কার্যকর ভূমিকায় দেখতে চাই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে এটা বলবো না৷ বলা উচিত এই প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে৷ আগে সেভাবে গণমাধ্যমে আসত না, এখন আসছে৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আগে সেভাবে খেয়াল রাখত না, এখন রাখছে৷ ফলে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে৷
তারা মনে করেন, পুলিশের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি৷ তাদের কিছু বিভাগ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সেই ব্রিটিশ নিয়মেই তারা চলে৷ আর এই সংস্কারটা হচ্ছে না এর কারণ পুলিশকে অনেক বেশি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়৷ পুলিশের মধ্যে এমন কোন ক্যারিশমেটিক নেতা আসেনি যে তারা নিজের উদ্যোগেই সংস্কার করবে৷ আর আমাদের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তাতে পুলিশের মধ্যে এই দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে৷ অনেকেই অল্প দিনে ধনী হতে চান ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৪
আপনার মতামত জানানঃ