অভাবের তাড়নায় পরিবারকে সুখে রাখতে স্বদেশ ও স্বজনদের ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেয়া প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে অনেক নারী শ্রমিকও। যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত। প্রবাসে থাকা নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা আমরা প্রায় শুনে আসছি মিডিয়ার মাধ্যমে। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণ হতবাক করে দেয় সবাইকে।
ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন ন্যূনতম মানবাধিকার সুবিধা থেকে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকেরা দিনে গড়ে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। তাদের ৭৬ শতাংশ কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না। আর ২৭ ভাগ তাদের নিয়োগকর্তার কাছে হয়রানির হুমকি পেয়েছেন।
পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ না থাকায় বাংলাদেশ থেকে আরব দেশগুলোতে যাওয়া নারী শ্রমিকরা নানা নির্যাতনের শিকার হলেও প্রতিকার চাইতে পারেন না। বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের মধ্যে করা এক জরিপে এ সব তথ্য উঠে এসেছে।
‘বাংলাদেশি নারী অভিবাসীদের ওপর কোভিড ১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা কেন্দ্র (ইফপ্রি)। গতকাল বৃহস্পতিবার(১২ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক কর্মশালায় গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি।
ওই জরিপের আওতায় বিদেশ ফেরত ৬৫৫ জন নারীর তথ্য নেওয়া হয়।
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে প্যানল আলোচনায় বক্তারা বাংলাদেশি নারী অভিবাসন শ্রমিকদের দুরবস্থার চিত্র ও এর সমাধানে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।
গবেষণা অনুসারে, নির্যাতিত হওয়াদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েও কোনোরকমে বেতন-ভাতা পাননি।দেশে ফেরার সময় নারী শ্রমিকদের ৪৩ শতাংশ নির্ধারিত বেতনের কম পেয়েছেন।
নারী অভিবাসীদের ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিষয়ে করা এই মোবাইল জরিপে দেখা গেছে— আরব দেশগুলোতে যাওয়া নারী অভিবাসীদের ২৮ শতাংশ কখনও স্কুলে যাননি। ৪৭ শতাংশ প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, মাধ্যমিক বা দাখিল পাসের সংখ্যা ১৯ শতাংশ আর উচ্চ মাধ্যমিক বা আলিম পাসের হার ১৯ শতাংশ।
এদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসেন ৬০ শতাংশ। তবে মাত্র ১০ শতাংশ জানিয়েছেন কোভিড-১৯ জনিত প্রভাবে তারা দেশে ফিরে এসেছেন। এদের অধিকাংশই ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসেন।
৬৫৫ জনের মধ্যে ৫৫ শতাংশই বিবাহিত। ডিভোর্সী ১৬ শতাংশ। অবিবাহিত ৭ শতাংশ। বিধবা ১১ শতাংশ। ছাড়াছাড়ি হয়েছে এমন আরও ১১ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে আয়োজকরা বলেন, ‘অধিকাংশই বিবাহিত এবং তারা পরিবারের খরচ চালানোর জন্যই বিদেশে শ্রমিক হিসেবে অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন।’
দেশে ফিরে নারী শ্রমিকের ৫৩ শতাংশ আর কাজ খোঁজার চেষ্টা করেননি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আর ২৬ শতাংশ চেষ্টা করেও কাজ খুঁজে পাননি।
গবেষণার তথ্য বলছে, নারীদের মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে, ২৩ শতাংশ জর্ডান, ১১ শতাংশ লেবানন থেকে। তাদের ৭০ শতাংশ ছিলেন আবাসিক গৃহকর্মী, ২০ শতাংশ গার্মেন্ট কর্মী। অংশগ্রহণকারী শ্রমিকের ৩৭ ভাগ বিদেশে ছিলেন মাত্র এক থেকে দুই বছরের মতো সময়। আর ২৬ শতাংশ অবস্থান করেছেন এক বছরের কম সময়।
ফেরত আসা নারী শ্রমিকের ৪১ শতাংশের বিদেশে কোনো নারীবন্ধু ছিল না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
নির্যাতিত হওয়াদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েও কোনোরকমে বেতন-ভাতা পাননি।দেশে ফেরার সময় নারী শ্রমিকদের ৪৩ শতাংশ নির্ধারিত বেতনের কম পেয়েছেন।
দেশে ফিরে আসার পর এ সব নারী হয়ত জানে বেঁচে গেছেন কিন্তু এখানেও নানারকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার তারা। কারও কারও পরিবার তাকে আর গ্রহণ করতে চায়নি। কারও স্বামী আবার নতুন বিয়ে করেছে। খালি হাতে দেশে ফিরে আসায় পরিবারের সদস্যদের জবাবদিহিতার মুখোমুখিও হয়েছেন অনেকেই। প্রত্যাবাসী নারী শ্রমিকদের ৫৩ শতাংশ দেশে কোনো কাজ খোঁজেননি। ২৬ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ আবার বিদেশের চেয়ে কম আয় করছেন।
বিদেশে কাজ করতে যেয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া, নামমাত্র খাবার ও বেতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর আরও কিছু দিক রয়েছে। ১৪ শতাংশ নারী প্রত্যাবাসী শ্রমিক জানিয়েছেন তাদের কোনো অভিবাসন ব্যয় হয়নি। খরচ করে যারা অভিবাসন করেছেন তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পরিবার অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেছেন, ২৮ শতাংশ স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন। প্রতিটি নারীর গড়ে ৫১ হাজার ৩০০ টাকা (৬০০ মার্কিন ডলার) অভিবাসন খরচ হয়েছে। তুলনায় তাদের গড় মাসিক হাউজহোল্ড ব্যয় ১১ হাজার টাকা (১২৮ মার্কিন ডলার)।
৪৩ শতাংশ নারী প্রত্যাবাসীই জানিয়েছেন যে তাদেরকে যে বেতন দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার চেয়ে কম বেতন পেয়েছেন। ২৭ শতাংশ কোনো না কোনো নির্যাতন বা হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হয়েছেন। ৪১ শতাংশ অভবাসী নারী শ্রমিকদের সেদেশে কোনো নারী বন্ধু বা পরিচিত কেউ ছিল না। প্রত্যেককেই দিনে গড়ে ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছে এবং ৭৬ শতাংশ একদিনের জন্যও সাপ্তাহিক ছুটি পাননি।
কর্মশালায় গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন নিউজিল্যান্ডের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নাজমুন নাহার। তিনি বলেন, নারী শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়ে ঘরে আবদ্ধ থাকেন। দীর্ঘ সময় কাজ করেন। এটা আধুনিক দাসত্ব।
কর্মশালায় প্যানেল আলোচনা হয়। তা সঞ্চালনা করেন ইফপ্রি–এর গবেষক মুজনা আলভি। আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম, পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নমিতা হালদার ও বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের (বিএনএসকে) নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম।
সাদেকা হালিম বলেন, অন্যান্য দেশ নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের ওপর যে বিনিয়োগ করে, বাংলাদেশ সরকার ততটা করে না। বিদেশে পাঠানোর আগে ভাষার ওপর কিছুটা জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যৌন–শোষণ সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে না। এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কারণে হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের বাহিরে পাঠানোর আগে মানসিকতায় থাকে যে তাদের কাজের জন্য পাঠানো হচ্ছে। কাজের বাইরে অন্য কিছু আর প্রাধান্য পায় না।
সৌদি আরবের প্রসঙ্গ টেনে সাদেকা হালিম বলেন, কোনো শ্রমিক তার কর্মস্থল থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও গেলে তিনি অবৈধ হবেন না। কারণ, সেখানে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক ধর্ষণের সাজা হয় না।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নমিতা হালদার বলেন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ভারতের গৃহকর্মীরা যেভাবে পুলিশে কল করে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের মেয়েরা তা করেন না বলে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পুলিশ। অভিযোগ করতে না চাওয়ার কারণটা ভাষাগত দক্ষতা না থাকা। ভাষা একটি সম্পদ।
নমিতা হালদার আরও বলেন, নারী শ্রমিকদের সঠিকভাবে বিদেশে পাঠাতে হলে দেশের দালালদের একই ছাতার নিচে আনতে হবে। সে জন্য তাঁদের শিক্ষিত করতে হবে। অন্যান্য দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দর–কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকের বেতন বাড়াতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো পারে না। তার দাবি, প্রতিটি দেশের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো যোগাযোগ করলে নিগৃহীত কর্মীদের উদ্ধার করা আরও সহজ হবে।
সুমাইয়া ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের নারী অভিবাসী গৃহকর্মীরা বুঝে উঠতে পারেন না কখন বিশ্রামের সময় আর কখন কাজের সময়। এ জন্য সৌদি আরবে হোস্টেল সুবিধা চালু করা দরকার। সেখান থেকে শ্রমিকেরা বাসায় গিয়ে কাজ করবেন।
সুমাইয়া ইসলাম আরও বলেন, সরকার নারী শ্রমিকদের বিনা মূল্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। মেয়েদের এখন আওয়াজ তুলতে হবে। যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের উল্টো টাকা দিতে হবে। তাদের পাসপোর্ট ও প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ের খরচ শ্রমিক গ্রহণকারী দেশকে বহন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ