শ্রীলঙ্কায় স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের জেরে জনগণের তোপের মুখে পড়েছে দেশটির সরকার। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, জনরোষ থেকে ছাড় পাচ্ছেন না লঙ্কান মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও। পথ আটকে তাদের ওপর যেমন শারীরিক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি আগুন লাগানো হয়েছে অর্ধশতাধিক নেতার বাড়িগাড়িতে। এর মধ্যে একরাতেই বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে শ্রীলঙ্কার অন্তত ৩৩ সংসদ সদস্যের বাসভবন।
স্থানীয় খবরে বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের হাতে সড়কে এমপি-মন্ত্রীদের মার খাওয়া, তাদের বাড়িতে ক্ষুব্ধ জনতার আগুনের জন্য মাহিন্দা রাজাপাকসেই দায়ী। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অনুগত গুন্ডাদের দিয়ে হামলা করিয়ে মাহিন্দাই আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ-সহিংস করে তুলেছেন। শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীনদের ওপর সাধারণ মানুষের নিষ্ঠুর বদলার কারণ রাজাপাকসে পরিবারের বহু বছরের কুশাসন, ক্ষমতার দম্ভ ও দুর্নীতি। যেসব এমপি, মন্ত্রী, রাজনীতিক সাধারণ মানুষের চোখে দুর্নীতিবাজ, তারাই আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, গত সোমবার (৯ মে) রাতে শাসক দলীয় নেতাদের অন্তত ৩৩টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নেতাদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে অভিযোগে বেশ কিছু বেসরকারি সম্পত্তিতেও হামলা চালানো হয়েছে। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বেছে বেছে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বাড়ি-গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ক্রুদ্ধ জনতা।
জানা গেছে, সদ্য পদত্যাগকারী লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের মেদামুলনায় অবস্থিত পৈতৃক বাড়ি এবং কুরুনেগালায় অবস্থিত বাসভবনে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা।
এর আগে, শ্রীলঙ্কায় এক এমপির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের আক্রমণে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরেকজন।
লঙ্কান পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা কলম্বো উপকণ্ঠে সরকার দলীয় এমপি অমরাকীর্তি আথুকোরালার গাড়িতে হামলা চালালে তিনি দুজনকে গুলি করেন। এতে একজন মারা যান। এরপর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা তাকে ঘিরে ধরেন। পরে নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন ওই সংসদ সদস্য।
এছাড়া সোমবার রাতে হোমগমার মহাকুম্বুরা এলাকায় সংসদ সদস্য কুমারা ওয়েল্গামার গাড়িতে হামলা চালায় একদল বিক্ষোভকারী। এসময় তিনি গাড়ির ভেতরেই ছিলেন। এ ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ওই এমপি।
শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হামলার শিকার হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারাও। এরই মধ্যে লঙ্কান পুলিশের সিনিয়র ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (এসডিআইজি) দেশবন্ধু টেন্নাকুনকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার কলম্বোর গঙ্গারাম এলাকার কাছে এসডিআইজি দেশবন্ধুর গাড়ি ঘিরে ধরে একদল বিক্ষোভকারী। পরে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। এসময় পরিস্থিতি সামলাতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ ঘটনার একদিন আগেই এক এমপির পাশে দেখা গিয়েছিল দেশবন্ধুকে।
যেসব এমপি, মন্ত্রী, রাজনীতিক সাধারণ মানুষের চোখে দুর্নীতিবাজ, তারাই আক্রান্ত হচ্ছে।
চলমান বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যে শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্যরা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সেজন্য মঙ্গলবার দেশটির প্রধান বিমানবন্দর অবরোধ করেছিল সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। এদিন কাতুনায়েকে অবস্থিত বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারে গাড়ি রেখে অবস্থান নেয় একদল তরুণ।
এর কয়েক ঘণ্টা পরেই সহিংসতাকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয় রাজাপাকসে সরকার। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে লঙ্কান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, কাউকে সরকারি সম্পত্তি লুটপাট বা মানবজীবনের ক্ষতি করতে দেখলে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক বিক্ষোভ-সহিংসতায় সোমবার থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত আটজন, আহত হয়েছেন ২২০ জন। দেশটিতে কারফিউয়ের মেয়াদ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে শ্রীলঙ্কা। এরপর থেকে একের পর এক সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটি। বর্তমানে আর্থিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশটিতে। এই সংকট থেকে আদৌ দেশকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
এই পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে-সহ গোটা রাজাপাকসে পরিবারকে দায়ী করছে লঙ্কানরা। দীর্ঘদিন ধরেই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে। দল, মত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা একজোট হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ।
বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কিন্তু সেই ক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত বিফলে গেছে। বিরোধী দল এবং দেশের জনগণের তীব্র ক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা। চাপের মুখে রয়েছেন তার ভাই এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেও। এ ঘটনাকে দেখা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে অপ্রীতিকর পরিবর্তন হিসেবে। তবে রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভের কারণ কী? সবকিছু ছাপিয়ে ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই সামনে আসছে বারবার।
বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ থেকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। আর সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে রিজার্ভে ঘাটতি। আবার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এসবই ধীরে ধীরে দেউলিয়াত্ব ডেকে আনে শ্রীলঙ্কার জন্য। আর সংকটের এ আগুনে ঘি ঢালে দেশটির রাজনৈতিক অচলাবস্থা।
বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করে আসা রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ। এর মধ্যে অভিযোগ বেশি সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে। বলা হয়, ক্ষমতায় আসার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নিজ পরিবারের সদস্যদের বসানোই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মাহিন্দার জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণ তাদের আর চাইছে না- এটা বোঝার পরও দুই ভাই ক্ষমতা ধরে রাখতে নাছোড়বান্দা। সেনাবাহিনী ও পুলিশকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। এখন পর্যন্ত যত মানুষ হতাহত হয়েছে, বেশিরভাই হয়েছে পুলিশের গুলি ও টিয়ার গ্যাসে। পুলিশেরও সুমতি হওয়া প্রয়োজন। আইনজীবী, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, তরুণসহ সবাই রাজাপাকসে পরিবারের ওপর ক্ষুব্ধ। পুলিশের তা বোঝা উচিত; জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত। গোতাবায়া সেনাবাহিনী ও পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়েছেন। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ও সহিংসতা ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হবে না।
সাধারণ মানুষ চায়, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার অবিলম্বে পদত্যাগের পর একটি সাধারণ নির্বাচন। তারা চায়, নির্বাচনের পর জাতীয় ঐকমত্যের সরকার, যারা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারবে। সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও প্রচেষ্টা ছাড়া শ্রীলঙ্কাকে খাদের কিনারা থেকে ফেরানোর আর উপায় নেই। কিন্তু গোতাবায়া যদি ক্ষমতায় থাকার জেদ ধরে রাখেন, তাহলে আরও রক্ত ঝরবে, আরও সহিংসতা হবে; শ্রীলঙ্কা খাদে পড়বে। কেউ বাঁচাতে পারবে না। শ্রীলঙ্কার একজন ত্রাতা চাই। জনগণই তা খুঁজে বের করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ