এপ্রিল মাসে নারী ও কন্যাশিশুসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৪৩ জন। এর মধ্যে ১২২ কন্যাশিশু (১ থেকে ১৮ বছর) ও ১২১ জন নারী।
রোজার এই মাসে সারা দেশে ৮০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংস্থার কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আজ শনিবার (৩০ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ জানানো হয়। মহিলা পরিষদ জানায়, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে এপ্রিল মাসে মোট ২৪৩ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮০ জন, যার মধ্যে ৩৩ জন কন্যাসহ ৪৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার, ১৮ জন কন্যাসহ ৩০ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২ জন কন্যাসহ ৩ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ৬ জন কন্যাসহ ৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
তথ্য বলছে, ২ জন কন্যাসহ ৭ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন এবং ৭ জন কন্যাসহ ৯ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
মহিলা পরিষদ তথ্য বলছে, এপ্রিলে এসিড দগ্ধের শিকার ১ জন, ৩ জন অগ্নিদগ্ধের শিকার এবং এরমধ্যে ২ জনের অগ্নিদগ্ধের কারণে মারা গেছেন। ১০ জন কন্যাসহ ১১ জন অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ১ জন কন্যা অপহরণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন এবং নারী ও কন্যাপাচারের ঘটনা ঘটেছে ১টি।
যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩ জন, এরমধ্যে ৩ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০ জন কন্যাসহ মোট ২৬ জন।
পাশাপাশি ১০ জন কন্যা উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ২ জন কন্যা উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। বিভিন্ন কারণে ৩ জন কন্যাসহ ২৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ১ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
৪ জন কন্যাসহ ১৫ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ৯ জন কন্যাসহ ১৮ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ২ জন কন্যাসহ ৩ জন আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হন। ১ জন ফতোয়ার শিকার হয়েছেন।
২ জন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২ জন কন্যাসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ৪ জন। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১টি। এছাড়া ১ জন কন্যাসহ ৩ জন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ কন্যাশিশুদের জন্য কতটা ভয়াবহ?
বাংলাদেশের নারী ও কন্যাশিশুরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কিভাবে ঘটবে, এ প্রশ্নের জবাব কেউ জানে না।
জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে এ প্রশ্নের উত্থাপন একটি কঠিন বাস্তবতার জন্ম দেয়- নারী কি আসলেই মানুষ হিসেবে বিবেচিত; না পুরুষের প্রদত্ত ফতোয়া’র অধীনে।
বাংলাদেশের সমাজে পুরুষরাও বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত হয়। অনেক নিয়ন্ত্রণই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নারীর ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণ হিসেবে চেপে বসে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বপরায়ণতা।
করোনার মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ছাড়াও ধর্ষণ ও হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে। করোনার জন্য ঘরকেই সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অনেক নারী ও কন্যাশিশুর জন্য ঘরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এমন ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।
২০২১ সালে বাংলাদেশে এক হাজার ১১৭ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আগের বছরের তুলনায় এই হার ৭৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। পাশাপাশি একই বছর পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টায় ২৭২ জন কন্যাশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের (এনজিসিএএফ) ২০২১ সালের কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে শুধু ২০২০ সালেই ৬২৬ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণের শিকার প্রায় ১০০ জন শিশু প্রতিবন্ধী ছিল। অন্যদিকে, ৪৫ জনকে যৌন নিপীড়নের পরে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় ১৫৫ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়।
প্রায় ৮০৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও আটক অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন?
দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে শিশুর প্রতি সহিংসতা, যার কারণ আমাদের অনিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশুরা।
আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন বলেন, নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। দোষীদের খুঁজে বের করা বা দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং যে সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে তাদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনেক অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়েছে, নানা কৌশলে অনেকে বিচার এড়িয়ে চলছে। তিনি আরও বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক, অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার শিশু বা তার পরিবার বিচার চাইতেই ভয় কিংবা লজ্জাবোধ করছে।
সমাজে ঘটনাগুলো মেনে নেওয়ার মতো প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী-পুরুষসহ সকল শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-গোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানের উপাদানগুলোকে এসব নির্যাতনের ঘটনা ধ্বংস করে সমাজ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
এদিকে, আইন অনুযায়ী ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা অনুযায়ী অতিরিক্ত মামলার চাপ থাকায় ১৮০ দিনের সময়সীমা মেনে চলা বাস্তবিকভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তাই ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোসহ বাজেট ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে সরকারকে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর মানসিক, আর্থিক, সামাজিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ