গোটা পৃথিবী এই মুহূর্তে হিমসিম খাচ্ছে করোনার ধকল সামলাতে। এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে বিশ্বকে করোনা মুক্ত করার জন্য চালানো হচ্ছে গ্লোবাল ভ্যাকসিনেশন। পাশাপাশি আরও বেশি করে করোনা প্রতিরোধ করতে অধিকাংশ দেশ হেঁটেছে করোনার বুস্টার ডোজ প্রদানের পথেও। কিন্তু এরই মাঝে এবার জুড়ে বসল নতুন আতঙ্ক।
বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ হাজার ভাইরাস ‘নিঃশব্দে সঞ্চালন করছে’, যা মানুষের মধ্যে অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন প্রাণীদের শীতল অঞ্চলের দিকে ধাবিত করছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা যেহেতু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তাদের আদি বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করবে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন্য প্রাণীগুলো তাই প্রথমবারের মতো অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে মিলিত হবে।
নিবন্ধ অনুসারে, বিরূপ এ মিলনের ফলে ২০৭০ সালের মধ্যে এসব ভাইরাসের অন্তত ১৫ হাজার নতুন ভাইরাস সংক্রমণের জন্ম দেবে।
গবেষণার সহ লেখক গ্রেগরি অ্যালবেরি জানান, ‘আমরা রোগের উদ্ভবের জন্য একটি অভিনব এবং সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষণ করেছি, যা সম্ভবত আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকির জন্ম দেবে।’
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ বাস্তুবিদ অ্যালবেরি সতর্ক করেছেন, ‘আগামী দশকগুলো কেবল গরম নয়, বরং রোগ-বালাইয়ে বিপর্যস্ত হবে।’
আগামী দশকগুলো কেবল গরম নয়, বরং রোগ-বালাইয়ে বিপর্যস্ত হবে।’
গবেষণায় পাঁচ বছর ধরে ৩১৩৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে এসব স্তন্যপায়ী প্রাণীর পরিবর্তিত গতিবিধি বিশ্লেষণ করে কীভাবে ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে নিবন্ধে।
গবেষকদের মতে ২০৪০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে নতুন যোগাযোগ কার্যকরভাবে দ্বিগুণ হবে। প্রথম মুখোমুখির ঘটনা বিশ্বের সর্বত্র ঘটলেও, এ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু থাকবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
এদিকে ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মতো জীববৈচিত্র্য অন্য কোথাও দেখা যায় না। এই অঞ্চল বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর প্রজাতির আবাসস্থল। সেই সঙ্গে অন্ধত্ব, বন্ধ্যাত্বসহ মারাত্মক নানা রোগও সহজে ছড়াতে পারে এই অঞ্চলে।
উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্পদের সঙ্গে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এমন সব পরজীবী রয়েছে যা মানুষের জন্য বেশ ক্ষতিকর। পোকামাকড়, বিশেষ করে মশার মাধ্যমে এসব পরজীবী মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। যেমন, নেমাটোড কৃমির লার্ভা বহনকারী মশার কামড়ে মানুষের শরীরে ফিলারাইয়েসিস সংক্রমণ ঘটতে পারে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৃমি ফিলেরি মানবদেহে প্রবেশের পর দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে।
ফিলারাইয়েসিস আছে এমন কাউকে মশা কামড়ালে মশাটিও তখন সংক্রমিত হয়। আর সেটি তখন অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। কিছু নেমাটোড প্রজাতি মানবদেহের লিম্ফ্যাটিক ভেসেলস-এ জমা হতে থাকে। তখন লিম্ফ্যাটিক তরলের প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে টিস্যু প্রসারিত হতে শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পা আক্রান্ত হয়। ফলে অঙ্গবিকৃতি ঘটে যা এলিফেনটাইসিস নামে পরিচিত।
নেমাটোড শরীরের অন্যত্রও আঘাত হানতে পারে। যেমন হাত, বুক, কিংবা জননাঙ্গ। চোখে আঘাত হানলে তা ভয়াবহ হতে পারে। এর ফলে এমনকি মানুষ অন্ধও হয়ে যেতে পারে। অংকোসারকাইসিস বা রিভার ব্লাইন্ডনেস এক ধরনের পরজীবী কৃমির কারণে ঘটে যেগুলো নদীর তীর বা খাল পাড়ে বেড়ে ওঠা কালো মাছির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।
অন্যদিকে স্থির পানিতেও বিপদ লুকিয়ে থাকে, যেটির নাম সারকেরি। এই কৃমি লার্ভা জল শামুক থেকে বেরিয়ে পানিতে ভাসতে থাকে। পরে অন্য কোনো প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে। মানুষের সংস্পর্শে সারকেরি ত্বক ভেদ করে অন্ত্র বা মূত্রাশয়ের শিরায় প্রবেশ করতে পারে। সেখানে এগুলো শিস্টোসোমে পরিণত হয় এবং শত শত ডিম ছাড়তে শুরু করে। ফলে ব্যথা, পেটের সমস্যা, ডায়রিয়া এবং মল বা মূত্রের সঙ্গে রক্তপাতের ঘটনা ঘটতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে শিস্টোসোমিয়াসিস ফেলোপিয়ান টিউবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে যা বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। প্রাচীন মিশর এবং বর্তমানের সুদান অঞ্চলের ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপিতে এক ধরনের চোখের রোগের কথা জানা যায় যেটি ট্র্যাকোমা হিসেবে পরিচিত।
এই ব্যাকটেরিয়া প্রদাহ কোটি কোটি মানুষের হতে পারে। অন্ধত্বের অন্যতম কারণ এটি। বিশ্বের প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এসব রোগে আক্রান্ত হন। আশার কথা হচ্ছে, অনেক রোগের ঔষধ এরইমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে। যেমন আইভারমেকটিন, যেটি করোনা রোগের ক্ষেত্রেও মাঝেমাঝে ব্যবহার করা হয়। রিভার ব্লাইন্ডনেস এবং অন্যান্য পরজীবী সংক্রমণ প্রতিরোধেও তা ভালো কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিভার ব্লাইন্ডনেস প্রতিরোধে লাতিন অ্যামেরিকা এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বেশ ভালো কাজ করেছে এই ঔষধ।
কৃমির উপদ্রব প্রতিরোধেও ঔষধ ভালো কাজ করে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানীয় জলও রোগবালাই থেকে দূরে থাকতে সহায়ক। তবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগবালাই থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে অনেক কিছু করা এখনো বাকি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ