রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে পুলিশ কর্তৃক বেআইনি আটক, হয়রানির ও মুচলেকা নেওয়ার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। পাশাপাশি মা-ছেলেকে বেআইনি আটক ও হয়রানির প্রতিবাদে ভূমিকা রাখায় সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এবং প্রতিবাদকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছে সংস্থাটি।
মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘যেকোনো বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার এবং তা সরকারের জবাবদিহিকে নিশ্চিত করে। সৈয়দা রত্না ও তাঁর কিশোর ছেলেকে পুলিশ কর্তৃক বেআইনি আটক ও হয়রানি বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক পরিসর সংকোচনের উদ্বেগজনক চিত্র ফুটিয়ে তোলে।’
ফারুখ ফয়সল আরও বলেন, এই ঘটনায় পুলিশের বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আবার দেখা গেছে। ভিন্নমত, প্রতিবাদ ও আন্দোলন দমনে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে পুলিশের ক্রমাগত অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ প্রবণতা, বেআইনি আটক, বলপ্রয়োগ, মামলা, হুমকি, হয়রানি করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনে বেআইনি আটক, মুচলেকা নেওয়া, হয়রানি মৌলিক মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ লঙ্ঘন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অধীনে মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার সঙ্গেও এটা সাংঘর্ষিক।
ঢাকার পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো দিকের গলির মুখে খোলা জায়গাটি তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবে পরিচিত। সেখানে স্থানীয় শিশুরা খেলাধুলা করে, ঈদের নামাজ, জানাজাসহ স্থানীয় লোকজনের নানা সামাজিক আয়োজন হয়ে থাকে। ওই জমিতে কলাবাগান থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের প্রতিবাদ করায় গত রোববার স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে ধরে নিয়ে প্রায় ১৩ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখা হয়।
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনে বেআইনি আটক, মুচলেকা নেওয়া, হয়রানি মৌলিক মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ লঙ্ঘন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অধীনে মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার সঙ্গেও এটা সাংঘর্ষিক।
সৈয়দা রত্না কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি আরও অনেকের সঙ্গে আন্দোলন করে আসছিলেন তেঁতুলতলা মাঠে পুলিশের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো তৈরির জন্য এই মাঠ দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখে মাঠে ভবন নির্মাণের জন্য চারপাশে দেয়াল নির্মাণের কাজ নিয়ে ফেসবুক লাইভ করার অপরাধে তাকে ও তার কিশোর ছেলেকে কলাবাগান থানায় বেআইনিভাবে আটকে রেখে হয়রানি করা হয়।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে থানা করার প্রতিবাদে এলাকার শিশুরা ওই মাঠে খেলা করলে খেলতে যাওয়া শিশুদের কান ধরে উঠবস করিয়েছেন কলাবাগান থানা পুলিশের সদস্যরা। এছাড়া ওই শিশুরা যাতে মাঠে আর খেলতে না যায় সেজন্য নির্যাতনের ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করে হুমকি দেওয়া হয়। এতে শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তির দাবি জানায়। পাশাপাশি পুলিশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার ও নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় আরও বেশি সংবেদশীল হওয়ার আহ্বান জানায় আর্টিকেল নাইনটিন।
আর্টিকেল নাইনটিন যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। সংস্থাটি ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করে আসছে।
এদিকে রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ সংরক্ষণ করাসহ মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে পুলিশি হয়রানির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে অধিকারকর্মীরা।
রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্নাকে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনার সমালোচনা করেছেন অধিকারকর্মীরা। অভিযোগ ছাড়া নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়া কেন, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া কী, অভিযোগ ছাড়া এক নারীকে তুলে নেওয়া, গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন না করার মুচলেকা কেন—এসব প্রশ্ন তুলেছেন তারা। তেঁতুলতলা মাঠে থানা না বানানোর দাবি জানিয়ে তারা রত্নাকে আটকের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান।
সোমবার(২৫ এপ্রিল) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে অধিকারকর্মীরা এসব প্রশ্ন তুলেন ও ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গেলে এখন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় থাকা শহরে একটা খেলার মাঠ নিয়ে নেওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। এলাকাবাসী খেলবে কোথায়, এই জবাব কি কর্তৃপক্ষ দেবে?
রত্নাকে আটকের ঘটনা প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আবার দেখলাম। তিনি যদি কোনো আইন ভঙ্গ করতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ চাইলে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারে এবং তার ছেলেকেও তুলে নিয়ে গেল।’
গতকালের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তারা আইনি ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া বলেন, ‘মুচলেকার ভাষা হচ্ছে মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। আমরা বলি গণতন্ত্র, আবার বলি মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে, তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হোক। সরকারি কাজের তালিকা দেওয়া হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুজন নাগরিককে আটকে রাখা যায়। কিন্তু এ দেশে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি কোনো দিন হবে না? বলবে না তারা লজ্জিত বা দুঃখিত। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আটক করে একটি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া হয়েছে। এটি পরিকল্পিত। এলাকার অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য।’
নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি যে চেনা মুখ হলেই রেহাই পাওয়া যেতে পারে? এই দেশে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নাই? আইন কি নিজের মতো চলে না?’
রত্নাকে ছেড়ে দেওয়ার পরও সংবাদ সম্মেলন করার কারণ হিসেবে খুশী কবির বলেন, মানুষ প্রশ্ন করবে, জবাব চাইবে। নাগরিককের কী অধিকার, সুরক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা—এসব কথা বলতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ