জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপাকে বিশ্বের শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বর্তমান সময়ে যেসব শিশুরা জন্মগ্রহণ করছে, তারা তাদের পূর্ববতী প্রজন্মের তুলনায় সাত গুণ বেশি বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা নেই দেশের শিশুদের। তবে দেশের শিশুরাই সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন বা প্রায় দুই কোটি শিশু বিরূপ আবহাওয়া, বন্যা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশগত অভিঘাতের শিকার। এদের মধ্যে অনেক শিশুরই ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে। তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। শোষণমূলক শিশুশ্রম, শিশু বিয়ে এবং পাচারের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় লাখ লাখ শিশু।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সংকট। খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, বন্যার মতো দুর্যোগের প্রভাব পড়ছে দেশের শিশুদের ওপর। শিশু সুরক্ষা সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত না হওয়া, বাল্যবিবাহ, যথাযথ সময়ে জন্মনিবন্ধন না হওয়া, সহিংসতা, শিশুশ্রম ও নির্যাতনের মধ্যে পড়ছে শিশুরা।
জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যে উঠে এসেছে, দেশের ১০ জেলায় শিশু সুরক্ষা দুর্বল। সংস্থাটির মতে, মূলত জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে এসব অঞ্চলে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশু সুরক্ষার পরিমাপকে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নড়াইল। বাকিগুলো হলো নেত্রকোনা, মাগুরা, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলা। এসব জেলার শিশুদের মৌলিক অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। সহিংসতা ও নিপীড়নের মধ্যেও রয়েছে এসব এলাকার শিশুরা। একই সঙ্গে শৈশবে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে তাদের প্রতি প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের অন্তত ১১টি জেলা বিপর্যয়ের শীর্ষে রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব জেলা হলো কক্সবাজার, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান ন্যাটালি ম্যাকউলি এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, শিশুর জন্মনিবন্ধন, শিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, স্কুলের বাইরে শিশুদের সংখ্যা নিয়ে সারা দেশের জেলাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এতে শিশু সুরক্ষা দুর্বলতার দিক থেকে দেশের ১০ জেলার অবস্থান শীর্ষে দেখা যায়।
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতির মুখে পড়া ১১ জেলার বিষয়ে তিনি বলেন, এসব জেলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়া অঞ্চলে দুই কোটি শিশু বাস করছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের চিহ্নিত জেলাগুলোর শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ ক্ষতিকর বিষয়গুলো স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যস্ত এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের ঝুঁকি বেশি। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শিশু সুরক্ষার উদ্বেগ কমাতে ও সমাজসেবামূলক কর্মীদের শক্তিশালী করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ।
শিশুর জন্মনিবন্ধন, শিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, স্কুলের বাইরে শিশুদের সংখ্যা নিয়ে সারা দেশের জেলাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এতে শিশু সুরক্ষা দুর্বলতার দিক থেকে দেশের ১০ জেলার অবস্থান শীর্ষে দেখা যায়।
শিশুরা জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী না হলেও তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে উল্লেখ করে ইউনিসেফ বলছে, শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেন্স ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। বাংলাদেশে প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন বিরূপ আবহাওয়া, বন্য, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ফলে তারা শহরে এসে বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যস্ত অঞ্চলে শিশুরা সহজেই শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের শিকার হয়। দেশের ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। যাদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজনের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর। এসব শিশু সহজেই সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ শিশু (শূন্য থেকে আঠারো বছর)। এসব শিশুর ৮৯ শতাংশ বাড়িতেই সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুদের সহিংসতা ও নির্যাতনের কারণে সপ্তাহে ২০টি শিশুর মৃত্যু হয়। ৫১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগেই। একই সঙ্গে শিশুশ্রম ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংস্থাটি বলছে, শিশু ও নারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। কমেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, লৈঙ্গিক বৈষম্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও মৌলিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায়ও উন্নতি করেছে। তবে জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকায় এসব বিষয়ের উন্নতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। আবার শিশুমৃত্যুর হার কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার আর উন্নতি হয়নি।
জাতিসংঘের জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ বাংলাদেশ), ওয়ার্ল্ড ভিশন ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) আয়োজনে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ, চিলড্রেন অ্যান্ড ভায়োলেন্স টপ দ্যা এজেন্ডা অ্যাট ইনোভেটিভ ভিশনারি স্পিকারস ইভেন্ট’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। শিশুরা জলবায়ু ও পরিবেশগত অভিঘাতের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকিতে তা তুলে ধরে এই সূচক। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের শিশুরা দায়ী নয়, অথচ তাদেরকেই এর জন্য সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ুজনিত সংকটের সম্মুখভাগে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুরা। তাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, বাল্যবিবাহের শিকার, এমনকি যৌনকর্মীতেও পরিণত হচ্ছে।
এদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের শিশুরা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইউনিসেফ। এতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের শিশুরা তাপপ্রবাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি একসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সঙ্কট তৈরি করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।
ইউনিসেফ বলছে, এখনো যথাসময়ে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আসেনি বাংলাদেশে বহু শিশু। মোট শিশুর ৩৭ শতাংশকে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনা গেছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে ফসলের খেতে লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে। নিরাপদ পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনের ফলে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। তারা গৃহপালিতসহ অন্যান্য সম্পদ হারিয়ে ফেলছে। ফলে তারা বাসস্থানের খোঁজে শিশুদের নিয়ে শহরে পাড়ি জমায়। যেখানে মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। ২০৫০ সালে যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে দাঁড়াবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইদানীংকালে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর এই আমূল পরিবর্তনে অভিযোজন করতে গিয়ে বেশি দুর্যোগের কবলে পড়ছে শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন অনুষঙ্গগুলোর গুণগত মান খারাপ করে দেয়। ফলে শিশুরা নানারকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে পড়ে।
তারা বলেন, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের তালিকায় থাকা ওপরের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এ ক্ষতিকর প্রভাবের অসহায় শিকারে পরিণত এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক শিশুরা। সম্প্রতি বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ধারণার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলীয় শিশুরা।
আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাণে বাঁচার জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করতে হয় তার বেশিরভাগই শিশুদের অজানা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে চাই সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু বিপর্যয়ের অনেক সাধারণ চিহ্ন রয়েছে। তবে সবকিছুকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাঁধ ভেঙে গেছে বলার চেয়ে বাঁধটি সঠিকভাবে নির্মাণ হয়েছিল কিনা, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কিছু জেলায় কোনো না কোনো কারণে শিশুদের সুরক্ষা দুর্বল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। শিশুদের সুরক্ষার জন্য সেসব এলাকায় আরো মনোযোগ দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ