পৃথিবীর বুকে আয়তনে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র লেবানন। মাত্র ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশ। ক্ষুদ্র হলেও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে নানা আগ্রাসন, বাইরের হস্তক্ষেপ ও দেড় দশকের গৃহযুদ্ধ অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা দেশটি অন্ধকারে পতিত হয়েছে।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে রাষ্ট্র হিসেবে দেউলিয়া হয়ে গেছে পশ্চিম এশিার দেশ লেবানন। সোমবার(০৪ মার্চ) লেবাননের টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম আল জাদিদ চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন দিশটির উপপ্রধানমন্ত্রী সাদেহ আল শামি।
সাক্ষাৎকারে আল শামি বলেন, ‘ব্যাংক ডু লিবানের (লেবাননের কেন্দ্রী ব্যাংক) মতো আমাদের দেশও দেউলিয়া হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে চলছি আমরা এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি—জনগণের ভোগান্তি যেন কিছুটা হলেও কমাতে পারি।’
উপ-প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, লোকসানের পরিমাণ রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আমানতকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। তবে এ বণ্টন কত শতাংশ হারে হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি।
আল-সামি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ‘উপেক্ষা করার মতো নয়’। তাই ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা সবার জন্য অবারিত থাকতে পারে না।
এদিকে লেবানন দেউলিয়া হয়েছে, উপপ্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা অস্বীকার করেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রিয়াদ সালামেহ। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
গভর্নর রিয়াদ বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। আর্থিক খাতে ক্ষতি সত্ত্বেও এটি (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) এখনো আইনগতভাবে তার সব ভূমিকা পালন করছে।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে লেবানন। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে কমে গেছে দেশটির মুদ্রার মানও।
তবে শিগগিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পথ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। লেবাননের অর্থনীতি আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের কারণে বিদেশি জ্বালানি সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে আমদানি হ্রাস পেয়ে সংকট আরও গভীর হয়েছে।
‘ব্যাংক ডু লিবানের (লেবাননের কেন্দ্রী ব্যাংক) মতো আমাদের দেশও দেউলিয়া হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে চলছি আমরা এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি—জনগণের ভোগান্তি যেন কিছুটা হলেও কমাতে পারি।’
লেবাননের অর্থনীতির পতন শুরু হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর দেশটির দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসানের পর থেকে। গৃহযুদ্ধে বিবদমান পক্ষসমূহের নেতারা দেশটির রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন।
নতুন এই রাজনৈতিক নেতাদের তৎপরতায় প্রাথমিক পর্যায়ে উল্লম্ফন ঘটলেও পরবর্তীতে সীমাহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে ধস নামে লেবাননের অর্থনীতির
ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে লেবাননের মুদ্রা লেবানিজ পাউন্ডের। ফলে, খাদ্য, খাবার পানি, স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষার মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষের। প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না দেশটির বেশিরভাগ অঞ্চলে।
বিশ্বের ক্ষুদ্রাতনের দেশসমূহের মধ্যে লেবানন অন্যতম, আয়তন মাত্র ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমদানি করতে হয় দেশটিকে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে বর্তমানে লেবাননের ৮২ শতাংশেরও বেশি মানুষ দরিদ্রের জীবনযাপন করছেন, বেকার অবস্থায় আছেন ৪০ শতাংশ মানুষ।
২০১৯ সালে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়েছিল, করোনা মহামারি ও ২০২০ সালে বৈরুত বন্দরে ব্যাপক বিস্ফোরণে তা আরও ঘনীভূত হয়। ওই বিস্ফোরণে ২১৬ জন নিহত হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার এবং রাজধানীর একাংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তবে লেবাননের এই দুরবস্থার জন্য দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়ও কম নয়। জাতীয় ক্ষমতায় জেঁকে বাস রাজনীতিবিদরা গৃহযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য বলতে গেলে প্রায় কোনো উদ্যোগই নেননি। ফলে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক দাতা ও ঋণদানকারী সংস্থাগুলোও দিন দিন দেশটিকে আর্থিক সহায়তা ও ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবানন এমন একটি দেশ, যেখানে ৫৪ শতাংশ জনসাধারণ মুসলিম, ৪১ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৫ শতাংশ দ্রুজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা বণ্টনে রাষ্ট্রপতি খ্রিষ্টান, প্রধানমন্ত্রী সুন্নি মুসলিম এবং স্পিকার শিয়া মুসলিম। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এখানে এমন একটি বহুপক্ষীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে। এই ঐক্য ধরে রাখতে হলে লেবানিজদের ধৈর্য, ত্যাগ ও সহনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে যেমন হটাতে হবে, তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত ঐক্য রক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেবাননের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সন্ধান করা।
তারা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যকে যেভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি তছনছ করে দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে মুসলিম কোনো দেশ মনে হয় না, লেবাননকে নিরাপদ করতে পারে। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ আজ কোনো না কোনোভাবে ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয়ের শিকার। লেবানিজ শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থ কুক্ষিগত করার চেয়েও নিজ নিজ ধর্ম ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কথা ভাবতে হবে কিংবা জনগণকে তাদের সরকারকে সেটি ভাবতে বাধ্য করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ