ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের মধ্যেই প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি ছড়ানো, ধর্ম অবমাননা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার অভিযোগেও অল্প বয়সীদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ২০ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ১২ জেলায় ১৮টি মামলার কথা জানা গেছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ হিসাব দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক। এসব মামলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। মামলাগুলো করেছেন সরকারদলীয় লোকজন, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যক্তিরা। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে এই শিশু–কিশোরদের পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ লাখ থেকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেসবুকে ‘কটূক্তি করা পোস্ট’ শেয়ার করায় জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুরের পীরগঞ্জ ও পীরগাছা এবং নারায়ণগঞ্জে ছয় শিশু–কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের অভিভাবকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা বলছেন, শিশুরা না বুঝে পোস্ট শেয়ার করে। ভুল বুঝতে পেরে পোস্ট প্রত্যাহার করে ক্ষমাও চায়।
একটি শিশুর বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। গত বছরের অক্টোবরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার চাচা বলেন, অনলাইন ক্লাসের জন্য তার ভাইপো স্মার্টফোন ব্যবহার করছিল। হঠাৎ একদিন বাসায় পুলিশ এসে তার খোঁজ করে। পুলিশ জানায়, সে মুঠোফোনে বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করেছে। পুলিশকে দেখে ছেলেটি ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৭ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলেও এখনো আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলার বাদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় ময়মনসিংহের এক স্কুলছাত্রকে আসামি করা হয়। সে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে একটি পোস্ট দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর ক্ষমা চেয়ে সেটি সরিয়েও ফেলে। তার স্বজনেরা জানান, ঘটনার দিন বিকেলে সে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ক্ষমা চায়। এরই মধ্যে পুলিশ আসে বাড়িতে। তার মুঠোফোন দিতে বলে। রাতে ওই কিশোরকে থানায় দিয়ে আসেন স্বজনেরা। ১৫ দিন পর জামিনে মুক্তি পায়। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে সে। ভয়ে সে লেখাপড়া করতে পারছে না বলে জানান স্বজনেরা।
এই শিশু–কিশোরেরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে, পরিবারও একঘরে হয়ে আছে। ক্ষমা চেয়েও আইনি ঝামেলা এড়াতে পারেনি পরিবার।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দুই কিশোরীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে সাতটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই শিশু–কিশোরেরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে, পরিবারও একঘরে হয়ে আছে। ক্ষমা চেয়েও আইনি ঝামেলা এড়াতে পারেনি পরিবার।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ফোন করে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে রাজধানীর বনানী থানায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় নাটোর ও কুষ্টিয়ার দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাটোরের শিশুটির বয়স ১৩।
ফোনে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হলো কেন, এ প্রশ্নের জবাবে নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন দাস প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ফোন করেছিল। তবে কঠোর ধারা দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুটির বিরুদ্ধে ২৩(৩) ধারায় মামলা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ১০ বছর কারাদণ্ড বা সাত লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২০২০ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে মুঠোফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বাইরে পাঠানোর অভিযোগে দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা হয়। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করা হয়।
আইনজীবী ইমাম হাসান তারেক বলেন, বিকল্প থাকলেও অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ, আইনটির কিছু ধারা জামিন অযোগ্য। যারা মামলা করছেন, তাদের উদ্দেশ্য আসামিরা যেন সহজে জামিন না পান, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বিবেচনা করছেন না তারা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এসব শিশু–কিশোর সাময়িকভাবে বিষণ্নতা এবং আঘাত–পরবর্তী মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। লঘু পাপে গুরু দণ্ডের কারণে পরে কেউ কেউ গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
সম্প্রতি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিনের’ এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) ২২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে।
এদিকে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম কর্মীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই সরকার এমন আইন করেছে। তবে এসব অপরাধের বিচারে প্রচলিত আইনই যথেষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ