সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন৷
প্রতিটি মানুষই নিজের মতো করে সুন্দর। কিন্তু সেই বিষয়টিকে মেনে নেওয়ার মতো সৎ প্রবণতা আমাদের মাঝে নেই। তাইতো হুটহাট আমরা কারো কারো দৈহিক আকার, ওজন, আয়তন বা গড়ন নিয়ে প্রকাশ্যে ঠাট্টা, সমালোচনা, বিদ্রুপ করি। নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেই, অসভ্য-বর্বর এই কাজটি হলো বডি শেমিং।
বডিশেমিং কী?
অতিরিক্ত বা কম ওজন, গায়ের রঙ, চোখ ছোট-বড়, নাকটা একটু বোঁচা, মুখে ব্রণ বা কাটা দাগ আছে- এমন চেহারা নিয়ে প্রতিদিন হাসি-ঠাট্টার ছলে আমরা কতকিছুই না বলে থাকি।
এ সব বাজে কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে ওই ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন। তার মধ্যে তৈরি হয় একধরনের বিষন্নতা, যা ধীরে ধীরে মানসিক অসুস্থতায়ও পর্যবসিত হতে পারে। যে যেমন, তাকে তেমনভাবে মেনে নিতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের, এই দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।
যারা বডি শেমিং করছেন, তারা যদি ভেবে থাকেন- আপনার এহেন মন্তব্য ব্যক্তির জীবন পাল্টে দেবে, আপনার ধারণা তবে একদমই ভুল। একনাগাড়ে মানুষের মুখ থেকে এমন কটুকথা শুনতে শুনতে নিজের উপরই বিতৃষ্ণা জন্মে মানুষের। কেউ কেউ এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে বেছে নেয় বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। আসলে আমাদের মস্তিষ্কে সৌন্দর্যের এমন কিছু বাঁধাধরা-ছক কষা সংজ্ঞা ঢুকে গেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কষ্টসাধ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে বডি শেমিং এমন মহামারী আকার ধারণ করায় এ অঞ্চলে দুর্দান্ত সাফল্যের সাথে টিকে আছে রঙ ফর্সা করার ক্রিম আর স্লিমিং টি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো।
বডি শেমিং কারা করে
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি করে তিন ধরনের মানুষ।
১. অসম্ভব হীনমন্যতায় ভোগা মানুষ যারা আরেকজনের মনে আঘাত দিয়ে শান্তি লাভ করে (সাধারণত বডি শেমিংয়ের ভিকটিম)
২. অবুঝ মানুষ যারা একটা কথা বলার পরে তার কী ফলাফল হতে পারে তা বুঝতে অক্ষম অথবা অরাজি।
৩. সত্যিকারের খারাপ মানুষ যারা কোনো কারণ ছাড়া মানুষের মনে কষ্ট দিতে ভালোবাসেন।
আমরা বেশির ভাগ মানুষ দুই নম্বর গোত্রে পড়ি। একটা কথা বলার পরে সেটার পরিণতি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বিশেষ করে বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কথা বলার সময় অপরপক্ষে যিনি বসে আছেন, তাকে মানুষ বলে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সব সময় বোধ করেন না। ব্যাপারটি অনেকটা এ রকম—চোখে তো আর দেখতে পাচ্ছি না, ক্ষতি কী যা খুশি তাই বললে?
প্লাস্টিক সার্জারি ও বডি শেমিং
প্লাস্টিক সার্জারির জনক ভারতীয় সার্জন শুশ্রুতা যখন ৬০০-১০০০ বিসি যুগে সর্বপ্রথম রাইনোপ্লাস্টি (নাকের পুনর্গঠন) শুরু করেন তখন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেই সব দুর্ভাগাদের উপকার করা যারা কোনো কারণে তাদের নাক হারিয়েছে (সে যুগে সাধারণত চুরি বা ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ নাক কেটে দেওয়া হতো)।
তিনি যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন যে তার আবিষ্কৃত কৌশলের উন্নতি সাধন করে এখন হাজার হাজার সুস্থ সবল নাক সার্জনের টেবিলে স্বেচ্ছায় কাটাছেঁড়া হওয়ার জন্য যাচ্ছে, আমার ধারণা তিনি তার ছাত্রদের এই স্কিল শেখানোর আগে দুবার ভাবতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও প্লাস্টিক সার্জারি জনপ্রিয়তা পায়। তবে তা মূলত যুদ্ধে আহত সেনাদের ক্ষতবিক্ষত চেহারা ঠিক করতেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ব্রিটিশ সেনা হাসপাতালে নানা ধরনের চিকিৎসার পরে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশের মুখে ছিল ভয়াবহ ক্ষত। মূলত শার্পনেল বা শেলের টুকরো অনেকেরই চেহারার একটা বড় অংশকে পুরোপুরি চেনার অযোগ্য করে দিয়েছিল।
হ্যারল্ড গিলিজ নামে নিউজিল্যান্ডের এক ইএনটি চিকিৎসক আহত এই ধরনের সেনার চিকিৎসা করছিলেন ‘ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এ। তিনিই প্রথম এই ধরনের পুড়ে যাওয়া বা একেবারে ক্ষতবিক্ষত মুখগুলোর উপরে ‘কসমেটিক সার্জারি’ করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
১৯১৬ সালে অলডারশটে তৈরি হয় ব্রিটেনের প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। কেমব্রিজ সেনা হাসপাতালে আহত ব্রিটিশ সেনাদের মুখে সেই প্রথম ‘স্কিন গ্রাফটিং’ শুরু করেন চিকিৎসক গিলিজ। একেবারে শুরুতে দু’শো জন মতো রোগী আশা করেছিলেন গিলিজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সংখ্যাটা তখনই দু’হাজার ছাড়িয়েছে। কোনও আহত সেনার ক্ষতবিক্ষত মুখে দেহের অন্য অংশ থেকে চামড়া নিয়ে মুখে জোড়ার কাজ শুরু হয় সেই সময় থেকেই।
তবে ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী (www.statista.com) ওই বছর আমেরিকাতে প্রায় ৪২ লাখ মানুষ কসমেটিক সার্জারি করিয়েছে এবং এর মাঝে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে ব্রেস্ট এনহ্যান্সমেন্ট সার্জারি। কেউ যদি বলেন এই বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রত্যেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলেই ব্রেস্ট সার্জারি করিয়েছেন, এমন কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না, স্ট্যাটিস্টিক্স তো নয়ই। একটি ভিডিও দেখে জানলাম, ভিয়েতনামে মায়েরা তাদের মেয়েদের জন্মদিনে প্রায়শই প্লাস্টিক সার্জারি উপহার দেন, কল্পনা করতে পারেন?
২০১৩ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি যে ভিডিও আপলোড হয় সেটি হচ্ছে—‘am I pretty or ugly’ এবং এগুলো আপলোড করেছে ৯-১৮ বছর বয়সী বাচ্চারা।
এসডব্লিউ/এসএস/২৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ