পাকিস্তানের একটি মহিলা মাদরাসার শিক্ষিকাকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তারই সহকর্মী ও দুই ছাত্র মিলে হত্যা করেছে।
দেশটিতে খুবই স্পর্শকাতর ‘ব্লাসফেমি’র অভিযোগে এটিই সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড। গত মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের ডেরা ইসমাইল খানে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও এএফপির প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
নিহত ওই মাদরাসা শিক্ষিকার নাম সফুরা বিবি। তিনি খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের জামিয়া ইসলামিয়া ফালাহুল বিনাত মাদরাসার শিক্ষিকা ছিলেন।
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, ওই নারী বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ও তাদের শিক্ষিকা নিহত সফুরা বিবির ওপর স্কুলের মূল ফটকে ছুরি ও লাঠি নিয়ে অতর্কিত হামলা করে।
এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সগির আহমেদ বলেন, দুই ছাত্রী ও এক শিক্ষিকা মিলে মাদরাসার প্রধান ফটকে সফুরা বিবির ওপর ছুরি ও লাঠি দিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এক পর্যায়ে তারা ছুরি দিয়ে গলাকেটে সফুরা বিবির মৃত্যু নিশ্চিত করে।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় মূল সন্দেহভাজন আসামি ওমরা আমান একই মাদরাসার শিক্ষিক। তিনি ওই মাদরাসায় অধ্যয়নরত তার দুই ভাগ্নিকে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন।
আরেক পুলিশ কর্মকর্তা আজিম খান জানান, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া দুই শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের এক আত্মীয় স্বপ্নে দেখেছেন নিহত সফুরা বিবি নবী মোহাম্মদকে (স.) নিয়ে কটুক্তি করেছেন। তাই তারা তাকে হত্যা করেছেন।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, নিহত মহিলার সঙ্গে ওমরা আমানের কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল কিনা সেটি তারা খতিয়ে দেখছেন।
সমালোচকরা বলছেন, পাকিস্তানের মাদরাসাগুলোতে কট্টরপন্থী ধর্মীয় শিক্ষকরা লাখ লাখ অসচ্ছল শিশুর মগজ ধোলাই করে থাকতে পারেন। এতে করে সেখানকার শিক্ষার্থীরা গণিত ও বিজ্ঞানের মতো মূল বিষয়গুলোকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, দেশটিতে ধর্ম অবমাননা বিষয়ক আইনগুলো প্রায়ই ব্যক্তি প্রতিহিংসার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তাদের এক আত্মীয় স্বপ্নে দেখেছেন নিহত সফুরা বিবি নবী মোহাম্মদকে (স.) নিয়ে কটুক্তি করেছেন। তাই তারা তাকে হত্যা করেছেন।
গত বছর, পাকিস্তানের একটি কারখানায় ম্যানেজার পদে কর্মরত এক শ্রীলঙ্কানকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বিক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে এবং তার মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিস। সংস্থাটির মতে, গত বছর পাকিস্তানে কমপক্ষে ৮৪ জনের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয় এবং একই অভিযোগে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানে ধর্মীয় যেকোনো বিষয়কে অত্যন্ত সংবেদনশীল হিসেবে দেখা হয়। দেশটিতে ইসলাম ধর্ম নিয়ে সামান্যতম অবমাননার ঘটনা ঘটলেও এর বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ হয়। সেখানে ধর্মনিন্দাকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে দেখা হয় এবং এর জন্য দায়ীদের পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য উসকানিও দেওয়া হয়।
পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে হত্যা নতুন কিছু নয়। গত কয়েকবছরে এসব ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ধর্মীয় সহিংসতা বন্ধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কার্যকর হয়নি। এমনকি কোনো বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।
ইসলামাবাদ ভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী তাহিরা আব্দুল্লাহ জানান, রাজনৈতিক উদাসিনতা হলো ধর্ম অবমাননা বিষয়ক আইন অপব্যবহার বন্ধের সবচেয়ে বড় বাধা। ইমরান খানের সরকার ধর্মীয় সহিংসতার হুমকি মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তার পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা নয়। তবে, পার্লামেন্টে প্রভাবশালী ধর্মীয় দলগুলোর আচরণও কাপুরুষতার পরিচয় দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধর্ম স্বাধীনতা কমিশনের তথ্য মোতাবেক, পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে ধর্মীয় সংঘাত অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।
ইসলাম ধর্মের মহানবীকে অপমান করলে পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে মুত্যুর সাজা হয়৷ প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে কঠোর ব্লাসফেমি আইন কার্যকর রয়েছে৷ পাকিস্তানে ব্লাসফেমির জন্য যতটা না ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি এই আইনের বলে সংঘবদ্ধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে৷
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
দেশটির সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ধর্ম অবমাননার ঘটনায় এক হাজার ৪১৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে এবং ওই সময় থেকে ২০২১ পর্যন্ত ধর্ম অবমাননার ঘটনায় ১৮ জন নারী এবং ৭১ জন পুরুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
তবে, এ ধরনের সব ঘটনায় মামলা না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা বেশি বলে ধারণা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার ৭০ শতাংশেরও বেশি অভিযোগ আসে পাঞ্জাব থেকে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মবিরোধী এই ব্লাসফেমি আইনটি সাধারণত ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের পাশাপাশি সাধারণ বহু পাকিস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়৷
তারা বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
তারা বলেন, পাকিস্তানের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে অস্পষ্টভাবে প্রণীত ব্লাসফেমি আইনগুলোর পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নির্বিচারে প্রয়োগ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই ‘ব্লাসফেমি’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এবং ‘ধর্মত্যাগ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৫৮
আপনার মতামত জানানঃ