পরিবেশ দূষণ আর গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্রমবর্ধমান নিঃসরণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছেই। ক্ষরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। সমুদ্র ফুঁসে উঠে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে যাচ্ছে স্থলভাগ গ্রাসের আতঙ্ক।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পাঁচটি সবুজ প্রবাল দ্বীপ ডুবে গেছে। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটারস সাময়িকীতে প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণা অনুযায়ী আরও ছয়টি দ্বীপ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে। ২০ শতকের তুলনায় উচ্চতা বৃদ্ধির হার এখন দ্বিগুণেরও বেশি। গত শতাব্দীর অধিকাংশ সময় বার্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধি ০.০৬ ইঞ্চি (১.৪ মিমি) থাকলেও ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালে প্রতি বছর ০.১৪ ইঞ্চি (৩.৬ মিমি) পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে।
কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই হারে বাড়া স্বাভাবিক নাকি কোনো অশনি সংকেত? নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালের ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে বিভিন্ন উপমহাদেশের প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, আমাদের জীবদ্দশায় কী কোনো দেশ বা শহর ডুবে যেতে পারে? এই দুর্যোগ প্রতিহত করার কি কোনো উপায় আছে?
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) থেকে জানা গেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ে এই সকল তথ্য।
সংস্থাটি জানায়, পরবর্তী শতাব্দীর শুরুতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০০০ সালের উচ্চতার তুলনায় এক ফুট (০.৩ মি) পর্যন্ত বাড়বে। অন্যদিকে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেলের অনুমান অনুসারে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৬ থেকে ২৫ ইঞ্চির পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
এবার যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি পব প্লাইমাউথের উপকূলীয় ভূতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক গার্ড ম্যাসেলিংক জানান, “কোনো দেশ বা শহর ডুববে কি না, তা নির্ভর করছে মানুষ হিসেবে আমরা এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী করছি তার ওপর। নেদারল্যান্ডসের অধিকাংশ ভূখণ্ড সমুদ্র উচ্চতার নিচে হওয়া সত্ত্বেও তা ডুবে যায়নি, কেননা ডাচরা উপকূলীয় বেষ্টনী নির্মাণের পাশাপাশি সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণও করছে।”
সবচেয়ে কম উচ্চতার দেশগুলো বিপদে আগে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।।ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস (ইউসিএস) অনুসারে, ১,২০০টি ছোট প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। প্রায় ৫৪০,০০০ লোকের বাসস্থান এই দেশের গড় উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট (১ মিটার)।
ইউসিএসের তথ্যানুসারে, মালদ্বীপের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র ১.৫ ফুট (৪৫ সেমি) বৃদ্ধি পেলে ২১০০ সালের মধ্যে দেশটি ৭৭ শতাংশ ভূমি হারাবে।
আরেকটি কম উচ্চতার দেশ হলো কিরিবাতি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশটির উচ্চতা প্রায় ৬ ফিট (১.৮ মি)। প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রে অবস্থিত দেশটির জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফিট বাড়লে দুই-তৃতীয়াংশ দ্বীপই ডুবে যেতে পারে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের বাড়তে থাকা উচ্চতার জন্য প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপের বসবাসরত জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখানকার প্রায় ৩০ লাখ দ্বীপবাসী উপকূল থেকে ৬.২ মাইল (১০ কিমি) দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। আর তাই শতাব্দী শেষ হওয়ায় আগেই বিশাল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে অলাভজনক সংস্থা সায়েন্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট নেটওয়ার্ক।
জনবহুল দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন। দেশটির ৪৩ লাখ জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত লাইফ অ্যাডাপ্টেড প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে, ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৩২ মিলিয়ন এবং ভারতের ২৭ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিতে থাকবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। আগামী শতাব্দীর শুরুতেই অসংখ্য মানুষের পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে। একথা ঠিক যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই হারে বাড়তে থাকলে খুব শীঘ্রই বহু ভূখণ্ড ডুবে যাবে, তারপরও এই শতাব্দীর মধ্যে খুব নিচু দেশগুলোও পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
ঢাকা কি ডুবে যাবে?
২০২১ সালের শেষের দিকে মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৮তম অধিবেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ প্লাবিত হয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের রিপোর্ট মতে, ২০১৯ সালে চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনের দুর্যোগের ফলে বাস্তুচ্যুতির পরিমাণ গোটা বিশ্বের ৭০%।
২০২১ সালে গ্লাসগোর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সেন্টার ফর ইনভার্নমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্যানুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ৯০ সেন্টিমিটারে পৌঁছবে।
২১০০ সালের মধ্যে কোনো দেশ নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে না থাকলেও বড় বড় বেশ কিছু শহর প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা উল্লেখযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা অন্যতম।
১০ মিলিয়ন মানুষের জাকার্তাকে বিবিসি বিশ্বের “সবচেয়ে দ্রুত ডুবে যাওয়া শহর” হিসেবে অভিহিত করেছে। হংকং ভিত্তিক অলাভজনক পরিবেশ সংস্থা আর্থের মতে, শহরটি প্রতি বছর ২ থেকে ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে জাকার্তার অধিকাংশ অংশই পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন যে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী বোর্নিও দ্বীপের নুসান্তারায় স্থানান্তরিত হচ্ছে যা জাকার্তা থেকে ১,২০০ মাইল দূরে অবস্থিত।
শুধু জাকার্তাই নয়, ঢাকার তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কম নয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুসারে, ২১০০ সালের মধ্যে ঢাকা, লাগোস ও ব্যাংকক পুরোপুরি অথবা আংশিক ডুবে যেতে পারে। এরমধ্যে ঢাকাই সবচেয়ে জনবহুল শহর।
তাহলে কী করা যেতে পারে? এই শহর ও দেশগুলোকে বাঁচানোর কি কোনো উপায় নেই? ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধজনিত নানাবিধ সমস্যার শিকার হবে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ জনগোষ্ঠী।
নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বন্যাঝুঁকি এড়াতে পারবে। দ্য নেচার কনজার্ভেন্সির প্রস্তাবিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধারসহ প্রবাল প্রাচীর সম্প্রসারণ। কিন্তু এই বিষয়গুলো স্রেফ নির্দিষ্ট কিছু জলবায়ু অঞ্চলের জন্যই প্রযোজ্য। তাছাড়া অনেকক্ষেত্রেই এসব পদক্ষেপ বেশ ব্যয়বহুল।
ফ্লোরিডার মিয়ামির ডেড কাউন্টির কর্মকর্তারা সম্প্রতি একটি প্রশমন কৌশল ঘোষণা করেছেন। এর মাধ্যমে ঘর ও রাস্তাগুলো উঁচু করার পাশাপাশি নিচু খোলা জায়গা রাখা হবে যার ফলে বন্যায় অবকাঠামোগুলোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো উপকূলীয় সুরক্ষা বেষ্টনী নির্মাণে বিনিয়োগে সক্ষম হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা সম্ভব হবে না। উন্নত দেশগুলো ট্রায়াল অ্যান্ড ইররের মধ্য দিয়ে হয়তো অনেক কিছু শিখতে বা জানতে পারবে। সে সুযোগও বাংলাদেশের মতো দেশের নেই।
কোনো শহর আসলেই ডুববে কি না তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের ওপর নির্ভর করছে না, বরং কোনো দেশ বা শহরের সেই উচ্চতাবৃদ্ধির ক্ষতিসমূহ ঠেকানোর জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা নির্মাণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। অধ্যাপক গার্ড ম্যাসেলিংকের মতে, বাংলাদেশের ভাগ্য খুব একটা ভালো নয়।
তিনি বলেন, কোনো নিম্নভূমির দেশ যদি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ হয় তাহলে আগামী দশকগুলো সম্ভবত ভালো মতোই কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু দেশগুলো অস্থিতিশীল ও দরিদ্র হলে উপকূলে সমুদ্রের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হবে।
সেজন্যই উন্নয়নশীল নিচু শহর ও দেশগুলো সর্বাধিক ঝুঁকিতে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। এসব কথা মাথায় রাখলে ১০০ বছর পর আমাদের পৃথিবী দেখতে কেমন হবে?
আগাম বলাটা কঠিন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার অনিশ্চিত। এটা অনেকটাই গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ওপর নির্ভরশীল। মূল বিষয় হলো সমাজ ও দেশগুলো কীভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব প্রশমন করতে ইচ্ছুক তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২:৪০
আপনার মতামত জানানঃ