পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভিতে সংবাদ দেখতে বসলেই সামনে উপস্থিত হয় একটির পর একটি অবাঞ্ছিত-লোমহর্ষক ঘটনা। প্রচার হতে থাকে বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া খুন, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতির খবর। আর এই মুহূর্তে কয়েকটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গোটাদেশ তোলপাড়।
অথচ জেনে অবাক হবেন, পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে ২০১৯ সাল থেকে হত্যাসহ অপরাধের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং কলেজ ছাত্রী প্রীতি হত্যাকাণ্ডের পর খুন হয়েছেন “গরিবের ডাক্তার” বলে পরিচিত ডেন্টিস্ট আহমেদ মাহী বুলবুল। রোববার একই দিনে একজন গৃহবধুও খুন হয়েছেন। ঢাকার বাইরেও ওই দিন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
এ সব মিলেই প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ করেই কি হত্যাসহ অপরাধ ঢাকাসহ সারাদেশে বেড়ে গেছে, নাকি ক্রমাগত বাড়ছে। এর পরিসংখ্যানটা কী?
ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান
ব্যক্তি উদ্যোগে পাওয়া পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বছরে ঢাকায় গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর সারাদেশে কম বেশি ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব বলছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২টি। তার আগে জানুয়ারি মাসে নয়টি। বছর হিসেবে দেখা যায় ২০২১ সালে ঢাকায় ১৬৬টি এবং ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তিন হাজার ৩৭৫টি, গড়ে প্রতিবছর ২৪১টি।
এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কখনো সামান্য কমে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। কোনো স্পর্শকাতর বা আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটলে তখন তা আলোচনায় আসে। পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। সংবাদমাধ্যমে আসে। কিছুদিন পর আবার চুপ।
অন্যান্য অপরাধের চিত্র বিশ্লেষণ করলে একই অবস্থা দেখা যায়। তবে অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। সবচেয়ে আলোচিত এবং নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিকারী একটি অপরাধ হলো ছিনতাই।
২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা শহরে মামলা হয়েছে তিন হাজার হাজার ৯৫৫টি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয়েছে ৪৩টি।
ডিএমপির হিসাব মেনে নিলেও স্পষ্ট যে ২০১৯ সালের তুলনায় গত দুই বছরে ছিনতাই বেড়েছে। তবে ছিনতাইয়ের এই হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ভুক্তভোগীদের বড় একটি অংশ ছিনতাই মামলা করতে থানায় যান না ভোগান্তিসহ নানা কারণে। আর নানা কারণে থানা ছিনতাইয়ের মামলা নিতে চায় না বলে অভিযোগ আছে।
সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান
সারাদেশে বছরে কত হত্যাকাণ্ড হয় এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েব সাইটে ২০১৮ সালের পর আর কোনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। ২০১৯ সালের আংশিক তথ্য আছে। এর পর আর নেই।
তাতে দেখা যায় ২০১৫ সালে সারাদেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে চার হাজার ৩৩৫টি। ২০১৬ সালে তিন হাজার ৫৯১টি, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৫৪৯টি, ২১৮ সালে তিন হাজার ৮৩০টি।
আর ২০১৯ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে মোট হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা আছে ৩৫১টি। অথচ ডিএমপির হিসাব বলছে ২০১৯ সালে ঢাকা শুধু ঢাকা শহরেই ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বছরে হত্যাসহ নানা অপরাধে প্রায় দুই লাখ মামলা হয়।
নানা পর্যায়ে কথা বলা জানা গেছে পুলিশ সদর দপ্তর ২০১৯ সাল থেকে অপরাধের তথ্য ওয়েবসাইটে দিচ্ছে না। এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, নতুন ওয়েবসাইট করার পর ২০১৯ সাল থেকে অপরাধের তথ্য দেয়া বন্ধ আছে। তথ্যের প্রয়োজন হলে আমাদের কাছে চাইতে হবে। ফিজিক্যালি এসে নিতে হবে।
কেন বাড়ছে অপরাধ?
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন, অপরাধ যে বাড়ছে তা যেমন নয়, তেমনি কমছেও না। তবে এটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আলোচনায় না আসলে অপরাধ নিয়ে কথাও হয়না।
ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতা বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ্যে খুন হওয়ায় এটা আলোচনায় এসেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মনে করছেন নেতার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে। সেখানে একজন নিরীহ ছাত্রীও খুন হয়েছেন। একইভাবে নৃশংসভাবে খুন হলে বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি খুন হলে আলোচনা হয়।
অপরাধ না কমার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিচার না হওয়ায় অপরাধ কমছে না। অপরাধীর বিচার হলে আর আইনের আওতায় আনা গেলে এই পরিস্থিতি হত না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
অন্য দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে অপরাধের তথ্য প্রকাশ বন্ধের সমালোচনা করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, আমরা এটা চালু করেছিলাম বাস্তব চিত্র জানাতে। এটা বন্ধ করা ঠিক হয়নি। অ্যামেরিকাসহ পৃথিবীর সবদেশেই তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর তথ্য অধিকার আইনেও তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে। এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। এটা বন্ধ করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে
আরও উন্নয়নের পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। অথচ আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি? কোন অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? কোনো অপরাধী যদি অপরাধ করে শাস্তি না পায়, ভুক্তভোগীরা যদি সুবিচার না পায়- তবে তো এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ব্যাপার।
অপরাধীরা আরও বেশি অপরাধ করার জন্য উৎসাহ পাবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে আইন আছে; কিন্তু আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নেই। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। অনেক ক্ষেত্রে আবার কিছু দুর্বল আইনের কারণেও অপরাধীরা অপরাধ করার উৎসাহ পেয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে জনগণের তীব্র আন্দোলন ও চাপের মুখে প্রচলিত আইন সংশোধনও করা হয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে যে হারে খুন, হত্যা, ধর্ষণের মতো নানা ধরনের অপরাধ বা অবাঞ্ছিত ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, তা উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো ঘটনার রেশ ধরে মানুষ রাস্তায় নামবে, আন্দোলন করবে, বিক্ষোভ করবে- আর তখনই প্রশাসনের টনক নড়বে, এটি সত্যিই লজ্জাজনক।
অপরাধীরা যেন কোনোভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে না পারে, সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ ও কঠোর দৃষ্টি থাকতে হবে। প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে প্রকৃত অপরাধীকে দ্রুত খুঁজে বের করার জন্য। কোনো অপরাধী যেন কোনোভাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে, কেউ যেন অপরাধ করতে সাহস না পায়, সেদিকে অবশ্যই আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ