চীন নিঃশব্দে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা-বিধ্বস্ত অর্থনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থনে অস্ত্র-গোলাবারুদ পাঠাবে না বলে জানিয়েছে চীন। তবে এ সংকট সমাধানে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কিন গ্যাং এ কথা বলেছেন। আজ সোমবার বিবিসি এ কথা জানিয়েছে।
ইউক্রেনে টানা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে রাশিয়া। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির অন্য অনেক শহরে রুশ সামরিক বাহিনী সফলতা পেলেও রাজধানী কিয়েভ অঞ্চলে এখনও সুবিধা করতে পারেনি তারা। এই পরিস্থিতিতে চীনের কাছে রাশিয়া অস্ত্র সহায়তা চেয়েছে বলে খবর বের হয়েছিল।
চীনের কাছে রাশিয়ার সামরিক ও আর্থিক সহায়তা চাওয়ার এই খবরটি চলতি মাসের মাঝামাঝিতে প্রকাশ করেছিল সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। ব্রিটিশ এই সংবাদমাধ্যমটি সেসময় জানায়, রাশিয়া চায় ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করুক চীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছিল, ইউক্রেনে আগ্রাসনের শুরু থেকেই চীনা সরঞ্জামের জন্য বেইজিংকে অনুরোধ করে আসছে রাশিয়া। অবশ্য রুশ কর্মকর্তারা চীনের কাছে ঠিক কী ধরনের সরঞ্জাম চাইছেন তা উল্লেখ করতে অস্বীকার করেন তারা।
মস্কোকে সাহায্য করবে না চীন
বেইজিং মস্কোকে সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করলে ‘পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত এমন মন্তব্য করলেন।
মস্কোকে অস্ত্র সহায়তা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে ‘গুজব’ বলে গত সপ্তাহে নাকচ করে দেয় বেইজিং। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে অনীহা দেখিয়ে আসছে চীন।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিবিএসকে কিন গ্যাং বলেন, পশ্চিমের এ প্রকাশ্যে নিন্দা জানানো কোনো কাজে আসবে না। এ জন্য প্রয়োজন ‘ভালো কূটনীতি’। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়াকে অর্থ-অস্ত্র দিয়ে সহায়তার বিষয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। বেইজিং বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
মস্কোও বলছে, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান সম্পন্ন করতে তাদের পর্যাপ্ত সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে। এ জন্য কোনো অস্ত্র সহায়তার প্রয়োজন নেই।
চীনের দ্বিমুখী অবস্থান
এছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে চীনের ওপর চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কাজে লাগাতে তারা চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
তবে বেইজিং যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও মস্কোর নিন্দা জানানো থেকে বিরত রয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মস্কোর নিন্দা জানিয়ে আনা প্রস্তাবেও ভোটদানে বিরত ছিল চীন।
যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে চীনের অবস্থান বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সংগত বলে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সংকটময় এ পরিস্থিতিতে চীন যে ইতিহাসের সঠিক পক্ষে আছে, তা সময়ই বলে দেবে।
সিনহুয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত শুক্রবার প্রায় দুই ঘণ্টা ভিডিও কলে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গত শনিবার এসব কথা বলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশির ভাগ দেশ কিয়েভের পক্ষে দাঁড়ায়। তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিত্র চীন। যুদ্ধ বন্ধে সংলাপের ওপর জোর দিয়ে আসছে বেইজিং।
রুবেলকে বাদ দেওয়া
চীনের মুদ্রা, ইউয়ান, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করে না। পরিবর্তে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না (PBOC) এর কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্ধারিত ব্যান্ডের মধ্যে চলে। গত সপ্তাহে, তারা রুবেল ট্রেডিং রেঞ্জের আকার দ্বিগুণ করেছে, যার ফলে রাশিয়ান মুদ্রার দ্রুত পতন ঘটতে পারে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রুবেল ইতিমধ্যেই ডলার এবং ইউরো উভয়ের বিপরীতে তার মূল্যের ২০% এরও বেশি হারিয়েছে।
ইউয়ানের বিপরীতে রাশিয়ান মুদ্রার পতন অব্যাহত থাকলেও বেইজিং মস্কোর কোনো উপকার করছে না। পরিবর্তে স্মার্টফোন এবং গাড়ির মতো চীনা দ্রব্য আমদানির জন্য রাশিয়ানদের এখন বেশি রুবেল দিতে হবে। যুদ্ধের আগে Xiaomi এবং Huawei এর মতো চীনা ফোন ব্র্যান্ডগুলি রাশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তারা রীতিমত Apple এবং Samsung এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল।
গ্রেট ওয়াল মোটর এবং গিলি অটোর মতো চীনা গাড়ি নির্মাতারা, রাশিয়ার বাজারের ৭% দখল করে আছে, গত বছর ১ লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি গাড়ি তারা বিক্রি করেছে৷ ট্রেডিং ব্যান্ড প্রসারিত হলে ইউয়ান রুবেলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, এর ওপর নির্ভর করে চীনা কোম্পানিগুলির ভবিষ্যত। চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে বর্তমানে, চীন-রাশিয়ার প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ইউয়ানে পরিচালিত হয়।
রিজার্ভের ওপর প্রভাব
সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে নাটিক্সিসের এশিয়া প্যাসিফিকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো লিখেছেন, ৯০বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইউয়ান রিজার্ভের মাধ্যমে চীন রাশিয়াকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে৷ যার জেরে রাশিয়ার রিজার্ভের প্রায় ৩১৫ বিলিয়ন ডলার হিমায়িত হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া অনুসারে, রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ এই সপ্তাহে বলেছিলেন যে মস্কোকে মার্কিন ডলার এবং ইউরো অ্যাক্সেস করতে বাধা দেওয়ার পরে দেশটি ইউয়ান রিজার্ভ ব্যবহার করতে চায়। পিপলস ব্যাংক অফ চায়না বা পিবিওসি এখনও পর্যন্ত এই মজুদ সম্পর্কে তার অবস্থান নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। গার্সিয়া-হেরেরো উল্লেখ করেছেন, চীন যদি মস্কোকে তার ইউয়ান রিজার্ভকে মার্কিন ডলার বা ইউরোতে রূপান্তর করার অনুমতি দেয়, এটি স্পষ্টভাবে রাশিয়ার বর্তমান অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের ঝুঁকি PBOC-এর জন্যও একটি বিশাল পদক্ষেপ হবে।
বিমানের যন্ত্রাংশ আটকে রাখা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অর্থ হল বিশ্বের দুটি প্রধান বিমান নির্মাতা সংস্থা বোয়িং (বিএ) এবং এয়ারবাস (ইএডিএসএফ), রাশিয়ান এয়ারলাইনগুলির জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বা রক্ষণাবেক্ষণ সহায়তা প্রদান করতে আর সক্ষম নয়৷
জেট ইঞ্জিন নির্মাতাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর অর্থ হল রাশিয়ান এয়ারলাইন্সগুলির কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ফুরিয়ে যেতে পারে, বা নিরাপদে বিমান পরিচালনার জন্য প্রস্তাবিত ঘন ঘন সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন না করেই বিমানগুলি উড়তে পারে। এই মাসের শুরুতে, একজন শীর্ষ রুশ কর্মকর্তা বলেছিলেন যে চীন রাশিয়ায় বিমানের যন্ত্রাংশ পাঠাতে অস্বীকার করেছে কারণ মস্কো বিকল্প সরবরাহের সন্ধান করছে।
রাশিয়ার এয়ার ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির প্রধান ভ্যালেরি কুডিনভ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসকে বলেছেন যে, রাশিয়া চীন থেকে বিমানের যন্ত্রাংশ না পেলে তুরস্ক এবং ভারত সহ অন্যান্য দেশগুলি থেকে যন্ত্রাংশ পাবার চেষ্টা করবে।
যদিও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিএনএন-কে জানিয়েছে যে চীন এবং রাশিয়া নিজেদের মধ্যে “স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা” বজায় রাখবে। চীন এবং রাশিয়া বোয়িং এবং এয়ারবাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে একটি নতুন দীর্ঘ পাল্লার, ওয়াইডবডি যাত্রীবাহী বিমান তৈরি করতে ২০১৭ সালে একটি বেসামরিক বিমান চলাচলের যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে।
ইতিমধ্যেই CR929-এর উৎপাদন শুরু হয়েছে, কিন্তু সরবরাহকারীদের নিয়ে মতবিরোধের কারণে বিষয়টি বিলম্ব হয়েছে। বিমানটি প্রাথমিকভাবে ২০২৪ সালে গ্রাহকদের জন্য পরিষেবা দেবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া ২০২৮ থেকে ২০২৯ পর্যন্ত সময়সীমা পিছিয়ে দিয়েছে।
অবকাঠামো বিনিয়োগ বন্ধ
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়া ও বেলারুশে তাদের সব কর্মসূচি স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক। এটি ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়াকে কোনো নতুন ঋণ বা বিনিয়োগ অনুমোদন করেনি এবং ২০২০ সাল থেকে বেলারুশে কোনো বিনিয়োগ অনুমোদন করেনি।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, সম্ভবত, বেইজিং-ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের সিদ্ধান্তটিও একই রকম। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে একটি বিবৃতিতে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছিল, ব্যাংকের সর্বোত্তম স্বার্থে রাশিয়া এবং বেলারুশ সম্পর্কিত তাদের সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক (ওয়াশিংটন, ডি.সি. ভিত্তিক) এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (যেখানে জাপান একটি প্রধান শক্তি), আপেক্ষিক প্রভাবের কারণে হতাশ হয়ে চীন ২০১৬ সালে AIIB বা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক চালু করে। সদর দফতর পরিচালনার পাশাপাশি চীন এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছে এবং এর ভোট ২৬.৫ %। ভারত ও রাশিয়ার রয়েছে যথাক্রমে ৭.৬ % এবং ৬%।
রাশিয়ায় কার্যক্রম স্থগিত করার AIIB-এর সিদ্ধান্তের অর্থ হল দেশের সড়ক ও রেল নেটওয়ার্কের উন্নতির লক্ষ্যে অনুমোদিত বা প্রস্তাবিত ঋণের ১.১ বিলিয়ন এখন আটকে আছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ