সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বিশাল দেহের বিভিন্ন প্রজাতির এক একটি ডাইনোসর। ডাইনোসর নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই জনমনে। বিজ্ঞানীরাও এ নিয়ে দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে ডাইনোসরের জীবাশ্ম। উন্মোক্ত হয়েছে অনেক রহস্য। তবে মানুষ যে তাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জেনে উঠতে পারেনি, তা প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিলুপ্ত এই প্রাণীটিকে নিয়ে এখনো চলছে গবেষণা। ডাইনোসর সংক্রান্ত বই কিংবা সিনেমা, সবই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশালাকার এই প্রাণীটি কেন বিলুপ্ত হলো তা নিয়েও বিভিন্ন সময় নানা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন গবেষকরা।
পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। তবে অতিকায় প্রাণীটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বিভিন্ন সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে ডাইনোসরের জীবাশ্ম। উন্মোক্ত হয়েছে অনেক রহস্য।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রারম্ভিক জুরাসিক যুগের একটি নতুন প্রজাতির সাঁজোয়া ডাইনোসরের সন্ধান পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) ই-লাইফ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে এমন তথ্য মিলেছে। খবর সিএনএনের।
চীনের ইউনান প্রদেশের ইউক্সি অঞ্চল ডাইনোসর আবিষ্কারের একটি হটস্পট। ২০১৭ সালে বিজ্ঞানীরা এখানে একটি সাঁজোয়া ডাইনোসরের নমুনা খুঁজে পান, যার নাম দেওয়া হয় ইউক্সিসারাস কোপচিকি।
এরপর ২০১৯ সালে সেখানে প্রাপ্ত নমুনার ওপর গবেষণা শুরু হয় বলে জানান ই-লাইফ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের লেখক যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুন্ডং বি।
নিবন্ধের আরেক লেখক লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক পল ব্যারেট বলেন, প্রাচীন এই প্রাণীটি থাইরিওফোরান শ্রেণিভুক্ত, যা অনেকটা এর নিকটবর্তী শ্রেণি স্টেগোসরাসের মতোই দেখতে।
গবেষণা নিবন্ধ অনুসারে, ডাইনোসরের নতুন এই প্রজাতিটি প্রথম থাইরিওফোরান শ্রেণিভুক্ত প্রাণী যা ১৭৪ থেকে ১৯২ মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চলে বাস করতো।
এক ইমেইল বার্তায় ব্যারেট বলেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশে পরিচিত হওয়ার পর এটিই প্রথম প্রারম্ভিক যুগের সাঁজোয়া ডাইনোসর। এ থেকে ধারণা করা যায়, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চলে প্রজাতিটি আবির্ভাবের পরপরই দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ইউক্সিসারাস কোপচিকি লম্বায় ৬.৬-৯.৮ ফুট (২-৩ মিটার) ছিল এবং এরা ফার্ন ও সাইক্যাডের মতো কম বর্ধনশীল উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকতো।
ডাইনোসরের নতুন এই প্রজাতিটি প্রথম থাইরিওফোরান শ্রেণিভুক্ত প্রাণী যা ১৭৪ থেকে ১৯২ মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চলে বাস করতো।
ব্যারেট বলেন, হাড়ের শক্ত আবরণ দিয়ে প্রাণীটির ঘাড়, পিঠ ও পা ঢাকা থাকতো, বর্মের উপরে ছিল বড় বড় কাঁটা। এই কাঁটা দিয়ে অনেকগুলো কাজ করতো প্রাণীটি। এর মধ্যে রয়েছে- শিকারের চোয়াল ও দাঁতকে বিচ্যুত করা।
নিজস্ব প্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বিবাদের সময় ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবেও প্রাণীটি এই দাঁতগুলো ব্যবহার করতো বলে ধারণা করেন ব্যারেট।
এ বিষয়ে শুন্ডং বি বলেন, বর্তমানে সজারু ও হেজহগও এ রকম আচরণ করে থাকে। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ১২০টিরও বেশি হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। গবেষকরা সেখানে একটি নতুন প্রজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট উপাদান পেয়েছেন।
দেহাবশেষের মধ্যে পাওয়া গেছে একটি একক কঙ্কালের একাধিক টুকরো, বর্ম প্লেটের অংশ, পা, চোয়াল ও মাথার খুলি। প্রাপ্ত নমুনার দানবীয় শরীর ও স্বতন্ত্র বর্ম গবেষকদের নিশ্চিত করেছে যে, এটি ডাইনোসরের একটি নতুন প্রজাতি।
বি আরও বলেন, এছাড়াও এই গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে ডাইনোসর ছিল খুবই বৈচিত্র্যময় ও এরা খুব দ্রুত উত্তর গোলার্ধে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এদিকে, ব্যারেট বলেন, সাঁজোয়া ডাইনোসরের নিকটতম প্রজাতি হলো তৃণভোজী স্কেলিডোসরাস ও ইমাউসরাস। উভয় প্রজাতিই জুরাসিক যুগে ইউরোপে আবির্ভূত হয়েছিল।
বিশাল শরীর আর দাপুটে মেজাজ নিয়ে প্রায় ১৭ কোটি বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে ডাইনোসর। পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী এবং বৈজ্ঞানিকদের অনুমান প্রভাবশালী প্রাণী এরা। প্রথম ডাইনোসরের বিবর্তন হয়েছিল আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্বে। কোটি কোটি বছর আগে তা বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে।
২৩১ থেকে ২৪৩ মিলিয়ন (২৩.১-২৪.৩ কোটি) বছরের মধ্যে ডাইনোসরের প্রথম আবির্ভাব। ১৭.৭ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে এদের বিচরণ ছিল। পাখিসদৃশ ডাইনোসর ছাড়া ৬ কোটি ৫৫ লাখ বছর আগে এদের বিলুপ্তি ঘটে। সে সময় ঠিক কী ঘটেছিল, বিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে পুরো একমত নন। কিন্তু এই বিলুপ্তির পেছনে উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতকে বেশ বড় করে দেখা হয়। এ ছাড়া অগ্ন্যুত্পাত থেকে রাসায়নিক নিঃসরণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্য কারণগুলোও বিবেচনা করা হয়।
ধারণা করা হয়, ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে অন্তত ১০-১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত গ্রহাণুর আঘাতের পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু গত বছর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং ও ব্রিস্টলের বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ফসিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, ওই উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতের অন্তত ৫ কোটি বছর আগেই ডাইনোসরদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। গ্রহাণুর আঘাতে সেটি শেষ হয় মাত্র। পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বলে তারা মনে করেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডাইনোসরের জন্মের সময় পৃথিবী ছিল উষ্ণ। কিন্তু দিনে দিনে পৃথিবী শীতল হয়ে আসতে শুরু করে। সমুদ্রের পানির উচ্চতাও নেমে যেতে শুরু করে। এর ফলেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ডাইনোসরের সঙ্গে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম অনেকটা একই সময়ে হলেও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শীতল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৬
আপনার মতামত জানানঃ