অতিমারির ফলে প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন হয়েছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বহু মানুষ গরিব হয়েছেন। গরিব আরও গরিব হয়েছে।
গত বছরের তুলনায় কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে আট কোটি মানুষকে ‘চরম দরিদ্রতা’য় ঠেলে দিয়েছে। মঙ্গলবার(১৫ মার্চ) প্রকাশিত এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির এক নতুন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
কি ইন্ডিকেটরস্ ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিক ২০২১’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারি এশিয়ার ও প্রশান্তমহাসাগরীয় এলাকায় নির্ধারিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্র বা এসডিজি অর্জনকে হুমকিতে ফেলেছে।
এডিবি তাদের ৪৯টি আঞ্চলিক সদস্য দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক ও পরিবেশগত পরিসংখ্যান বিস্তারিত মূল্যায়ন করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ৫.২ শতাংশ বা ২০ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্রতায় জীবনযাপন করছেন (২০১৭ সাল পর্যন্ত)। যদি কোভিড-১৯ হানা না দিতো, তাহলে ২০২০ সাল নাগাদ এ হার ২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছাত।
প্রতিবেদন অনুসারে বলা হয়েছে, এশিয়ার যেসব এলাকায় দারিদ্র, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল, মহামারির কারণে সেগুলোর অগ্রগতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। মহামারীর আগে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যারা চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যা বেশ খানিকটা কমতে থাকে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪.৯ মিলিয়ন, ২০১৮ সালে ১৮ মিলিয়ন এবং ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১.২ মিলিয়ন।
এডিবি প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া বলেছেন, ‘মহামারির কারণে ব্যাপক বেকারত্ব, অসমতা বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের মাত্রা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নারী, তরুণ শ্রমিক এবং বয়স্কদের মধ্যে এই সংখ্যা উল্লেখ যোগ্য ভাবে বেড়েছে’।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ৯৩ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
মহামারির সময় সংক্রমণ রোধে দেওয়া লকডাউনের কারণে এসব অঞ্চলের পর্যটনসহ অন্যান্য আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া এর কারণ।
কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় গত বছর ৪৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমায় প্রবেশ করে, জীবনধারণের জন্য দৈনিক ব্যয় নেমে আসে ১.৯০ ডলারেরও নিচে।
পাশাপাশি, এ অঞ্চলে লকডাউনে চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপের কারণে চলমান অসমতাও আরও বেড়ে যায়। অনানুষ্ঠানিক খাত- যেখানে নারী আর তরুণ জনগোষ্ঠী ও অদক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে, এসব খাতের ওপর বিধি-নিষেধের প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
‘দারিদ্র্য ও বেকারত্বের ওপর মহামারির যে প্রভাব পড়েছে তা সম্ভবত অব্যাহত থাকবে। কারণ কাজ করছে না এমন কর্মীদের দক্ষতা কমতে থাকবে আর দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা আরও সংকুচিত হবে’, বলা হয় এডিবির ওই প্রতিবেদনে।
তবে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসায় আর চলাচলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ৯৩ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
এদিকে, এ বছর ৫.১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। যদিও ওমিক্রনের প্রভাবে এ প্রবৃদ্ধি ০.৮ শতাংশ পয়েন্ট কমতে পারে।
এডিবি বলছে, ছোট ব্যবসায় ডিজিটাল টুলের ব্যবহার এবং কাজ হারানো কর্মীদের জন্য দক্ষতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে নিউ নরমাল সময়ের কর্মপরিবেশে কর্মীরা পিছিয়ে পড়বে না তা নিশ্চিত করা যাবে।
‘জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করলেও তা পরিস্থিতির উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে ১.৫ শতাংশ পয়েন্ট যোগ করবে’।
এডিবির প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়াসুউকি সাওয়াদা বলেন, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যতেষ্ট অগ্রগতি করছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এ অঞ্চলের যে আর্থ-সামাজিক চ্যুতি রেখাকে উন্মোচিত করেছে, যা অঞ্চলটির টেকসই এবং সর্বত্রব্যাপী উন্নয়নকে দুর্বল করে দিতে পারে। সেই সঙ্গে এডিবির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনা মহামারীর কারণে তাদের কাজ হারিয়েছেন। বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মহামারির আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতি ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জার্মানির পরেই। আর এখন মহামারির দাপটে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া এ বছরে তাদের জিডিপির পূর্বাভাসের সীমা অনেকটাই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। একই অবস্থা থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ এই অঞ্চলের বহু দেশের। গত অর্থবছরে উঠে দাঁড়ালেও ভিয়েতনামের অবস্থাও মহামারি পরিস্থিতিতে তথৈবচ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই সমস্যা থেকে খুব শিগগির বেরিয়ে আসার আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূলত ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানিই ছিল এই দেশগুলোর অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধে সেই সব শিল্পকারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, টানা কঠোর বিধিনিষেধ চালিয়ে গেলে কাজ হবে না, বরং টিকাদানের গতি অনেক গুণ বাড়াতে হবে। তা না হলে সংক্রমণে তো রাশ টানা যাবেই না, অর্থনীতি আরও মুখ থুবড়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ