আবার নতুন করে নাম-পরিচয়হীন আরও অনেক কবরের সন্ধান পেয়েছে কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়। উইলিয়াম লেক ফার্স্ট নেশন সোমবার জানিয়েছে, ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত ৯৩টি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
কানাডার পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রাক্তন কামলপস ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুল বা সেন্ট জোসেফ আবাসিক স্কুলের এলাকায় এই কবরগুলো পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই কবরগুলো সেন্ট জোসেফ আবাসিক স্কুলের ছাত্রদেরই।
প্রায় হাজার হাজার উইলিয়াম লেক ফার্স্ট নেশন ও অন্যান্য আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক সেন্ট জোসেফ স্কুলে রাখা হয়েছিল। এই স্কুলটি ১৮৮১-১৯৮১ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
গত বছর মে মাসেও এই আবাসিক স্কুলের আশপাশে প্রায় ২১৫টি নামবিহীন কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
কানাডা ১ লাখ ৫০ হাজার আদিবাসী শিশুকে ১৮০০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জোরপূর্বক আবাসিক স্কুলে যোগদানে বাধ্য করেছিল।
সেখানে শিশুদের থেকে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, ভাই-বোন থেকেও আলাদা করা হয়েছিল এবং এসব শিশু মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারও হয়েছিল।
হাজার হাজার শিশু মারা গিয়েছিল এমন পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে।
বিভিন্ন গীর্জা বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এই স্কুলগুলো পরিচালনা করতেন।
২০১৫ সালে দেশটির ফেডারেল কমিশনও তদন্তের পর এ ঘটনার সত্যতা পায়। তারা কানাডার আবাসিক স্কুল পদ্ধতিকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছে।
এই মাসের শুরুর দিকে কানাডার ফেডারেল সরকার উইলিয়াম লেক ফার্স্ট নেশনের জন্য ১.৯ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার তহবিল ঘোষণা করে, যাতে তারা প্রাক্তন আবাসিক স্কুলগুলোর সঙ্গে যুক্ত সমাধিগুলো নিয়ে তদন্ত করতে পারে।
সর্বোপরি নতুন এই কবরগুলো খুঁজে পাওয়ায়, জোরপূর্বক-আত্মীকরণ প্রতিষ্ঠানের শিকার হওয়া এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
কানাডার পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রাক্তন কামলপস ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুল বা সেন্ট জোসেফ আবাসিক স্কুলের এলাকায় এই কবরগুলো পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই কবরগুলো সেন্ট জোসেফ আবাসিক স্কুলের ছাত্রদেরই।
আঠারো-উনিশ শতকে কানাডা সরকার ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের যোগসাজশে আদিবাসীদের সঙ্গে হওয়া বর্বর আচরণের অধ্যায় ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। আদিবাসী সন্তানদের আধুনিক সমাজে খাপ খাওয়ানোর নামে জোরপূর্বক আবাসিক স্কুলে রাখার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন সরকার, তার ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। স্কুলগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় কয়েক হাজার শিশু। পরে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও কৌশলে চাপা পড়ে যায় আদিবাসী শিশুমৃত্যুর বিষয়টি। তবে সম্প্রতি ওই ধরনের বেশ কয়েকটি স্কুলে কয়েকশ’ কবরের সন্ধান পাওয়ার পর এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে।
গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী। তবে কানাডায় রেড ইন্ডিয়ানের পাশাপাশি ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও বসবাস ছিল।
দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কানাডায় দলে দলে ইউরোপীয় বসতকাররা (সেটলার) আসতে থাকে তখন দেশটির স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর গোত্রসমূহের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকটি সংঘাত হয়েছিল। ইউরোপীয় বসতকারদের হাতে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি থাকায় সবগুলো সংঘাতেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল আদিবাসীদের।
পরাজিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল বসতকাররা। বাকি যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদান ও ‘অধিকতর সভ্য’ করে তুলতে ১৮০০ সালের পর থেকে দেশটির প্রধান ক্যাথলিক গির্জার অধীনে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় দেশটিতে ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। কানাডার কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক গির্জার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলসমূহ পরিচালনা করতেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা।
কয়েক লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভর্তি করা হয়েছিল এসব স্কুলে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা ও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চর্চা নিষিদ্ধ ছিল এই শিশুদের জন্য। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো ক্রীতদাসের মতো এবং স্কুল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের হাতে নিয়মিত শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। সহ্যের অতীত নির্যাতনের ফলে বহু শিশুর মৃত্যু হতো। তখন তাদেরকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এসব সমাধিই এখন গণকবর।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা করা শুরু এসব স্কুল এবং সর্বশেষ স্কুলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ